জার্মানিতে বর্ণবাদী আস্ফালন

গত ৭৩ বছরে জার্মানি ইউরোপে বড় দেশ হিসেবে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি অগ্রগণ্য দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। রয়টার্স ফাইল ছবি
গত ৭৩ বছরে জার্মানি ইউরোপে বড় দেশ হিসেবে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি অগ্রগণ্য দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। রয়টার্স ফাইল ছবি

১৯৫৩ থেকে ১৯৯০ সাল। সাঁইত্রিশ বছর ধরে শহরটির নাম ছিল কার্ল মার্ক্স সিটি। সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার অন্যতম পথিকৃৎ জার্মানির এই সন্তানের নামে শহরটির নাম আবার বদলে যায় বার্লিন প্রাচীর পতনের পর; ১৯৯০ সালে। আবারও আগের কেমনিজ নামে ফিরে যায়। এই কেমনিজ শহর ঘিরেই গত আগস্ট মাসের শেষ দিক থেকে জার্মানির নব্য নাৎসি আর রক্ষণশীল কট্টরবাদীরা তাদের বাহুবল দেখাচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের সাক্সেন রাজ্য এখন নব্য নাৎসিদের অভয়ারণ্য। এই রাজ্যের ছোট-বড় সব শহরেই তারা আছে। তারা সাংবাদিক, অন্য মতের রাজনৈতিক কর্মী, অভিবাসী শরণার্থী—সবার ওপরেই চড়াও হচ্ছে। প্রায় ৪০ বছর সাবেক পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার ঘরানা আর বিগত ২৮ বছর ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে থেকেও কেন তারা আধুনিক উদার সমাজব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে না, তা এখন বড় প্রশ্ন।

গত ২৫ আগস্ট দুই পক্ষের মারামারি ও ছুরিকাঘাতের ঘটনায় এক কিউবান বংশোদ্ভূত জার্মান নাগরিক হাসপাতালে মারা যান। মারামারির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২২ ও ২৩ বছরের একজন সিরীয় ও একজন ইরাকি নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এ ঘটনাকে পুঁজি করে শহরের নব্য নাৎসি ও তাদের রক্ষণশীল অনুসারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়িয়ে পরদিন প্রায় ছয় হাজার মানুষকে জড়ো করে। কেমনিজ শহরের কেন্দ্রে কার্ল মার্ক্স স্মৃতিসৌধের কাছে জমায়েতের পর এরা শহরজুড়ে বিদেশি চেহারার মানুষদের মারধর ও নাজেহাল করে। এ ঘটনার জের সপ্তাহখানেক ধরে চলতে থাকে।

কেমনিজ পুলিশের মুখপাত্র ইয়ুরগেন গিহর্গ জানিয়েছেন, একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা থেকে রক্ষা করতে গিয়ে দুজন জার্মান বিদেশি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়। আসলে এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তদুপরি গত সপ্তাহের রবি ও সোমবার বিকেলে এত বিপুলসংখ্যক কট্টরপন্থী সমাবেশ করতে আসবে, তা পুলিশের ধারণার বাইরে ছিল। ঘটনার সময় পুলিশ কম ছিল বলে উগ্র কট্টরপন্থীরা বারবার পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যায়। এই অঞ্চলগুলোতে শরণার্থী ও অভিবাসীদের ওপর প্রায়শই হামলার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এবারের ঘটনা ছিল বেশ বড়। কেমনিজের এ ঘটনা পুরো জার্মানিতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে; স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সমালোচনা করা হয়। সাবেক পূর্ব জার্মানির পাঁচটি রাজ্যে অভিবাসীদের প্রতি ঘৃণাবিদ্বেষ এই প্রথম নয়। ১৯৯২ সালে রোস্টকে ভিয়েতনামের অতিথি শ্রমিক, পরবর্তীকালে শরণার্থী বাড়িঘরে সপ্তাহজুড়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, ২০১৫ সালে ড্রেসডেন শহরের কাছে হোয়ারভের্ডাতে দুই রাতজুড়ে শরণার্থীদের আবাসস্থলে তাণ্ডব চালানো হয়।

১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর জার্মানির ঐক্যপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। তারপর শুরু হয় ঐক্যবদ্ধ জার্মান গড়ার চ্যালেঞ্জ। তার আগে ৪৫ বছর ধরে দুই অংশে দুই ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল। পূর্ব জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতি ছিল, তবে তা ছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সেরা অর্থনীতি। পশ্চিমের অর্থনীতি পুঁজিবাদী হলেও সেখানে সামাজিক কল্যাণ ও মানবিকতা ছিল। সেই সমাজতান্ত্রিক আর ধনবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এক করে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল দুরূহ। মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন আবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ জ্বালানি—এসব সেবামূলক গ্যারান্টি, আর এই ধাঁচেই এগোতে থাকে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির অর্থনীতি। আইন, প্রশাসন, রাস্তাঘাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়। এসব করতে পশ্চিমের নাগরিকদের দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে সংহতি ভ্যাট িদতে হচ্ছে। তবু ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ-অধ্যুষিত পূর্ব জার্মানিকে নতুন ধাঁচে গড়ে তোলা সহজ হয়নি। সাবেক পূর্ব জার্মানিতে এই বর্ণবিদ্বেষ বিষয়ে জার্মানির অনেক সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, পূর্বাংশের অধিকাংশ নাগরিক বসবাস করেছে একটি বন্ধ্যা সমাজব্যবস্থায়। তারা সামাজিক ও মানবিক হয়ে উঠতে শেখেনি।

রক্ষণশীল রাজনীতিক ও নব্য নাৎসিবাদীরা সাবেক পূর্ব জার্মানির জনগণের এই মনোভাব রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। তারা ‘ইসলামীকরণের’ বিরুদ্ধে ২০১৪ সাল থেকে ড্রেসডেন শহরে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন বর্ণ ও শরণার্থীদের বিরুদ্ধে জমায়েত করেছে। গত বছরের ২৪ অক্টোবর জার্মানির জাতীয় নির্বাচনে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে পার্লামেন্টে ৯৪ আসন পেয়েছেন কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) দলটি। এটি এখন জার্মানির পার্লামেন্টের প্রধান বিরোধী দল।

অতীত ক্লেদাক্ত যুদ্ধবিগ্রহের অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর গত ৭৩ বছরে জার্মানি ইউরোপে বড় দেশ হিসেবে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি অগ্রগণ্য দেশ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। তবে এখন বর্ণবাদীরা জার্মানির মাটিতে যা ঘটাচ্ছে, তাকে রুখতে জার্মানি তথা ইউরোপের রাজনীতিতে নতুন ভাবনার সময় এসেছে।

সরাফ আহমেদ, প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি