সৌদি ভিশন যখন আমাদের ভীষণ

‘ভিশন ২০৩০’-এর ঘোষণা অনুযায়ী সৌদি আরব প্রয়োজনের অতিরিক্ত একজন বিদেশি কর্মীও রাখতে চায় না
‘ভিশন ২০৩০’-এর ঘোষণা অনুযায়ী সৌদি আরব প্রয়োজনের অতিরিক্ত একজন বিদেশি কর্মীও রাখতে চায় না

সৌদি আরবের মক্কায় এক যুবকের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি ফেনীর মানুষ। আট বছর আগে মক্কা গিয়ে একটা চার তারকা হোটেলে চাকরি শুরু করেন। তাঁর স্ত্রী এক সন্তান নিয়ে দেশের বাড়িতে থাকেন। তিনি নিয়মিত দেশে টাকা পাঠান, তাঁর পাঠানো টাকায় বোনের বিয়ে হয়েছে। তিনি আমাকে বললেন, ‘এ দেশে আর থাকতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।’ কারণ, ‘আকামা’র (সৌদি আরবে বিদেশিদের কাজ করার অনুমতিপত্র) চার্জ দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। আগে ছিল বছরে পাঁচ হাজার সৌদি রিয়াল (প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা), আগামী বছর থেকে সেটি হয়ে যাচ্ছে ১২ হাজার রিয়াল (প্রায় পৌনে তিন লাখ টাকা)! তা ছাড়া, প্রতি মাসে ২০০ রিয়াল করে অতিরিক্ত ‘স্যালারি ট্যাক্স’ দিতে হবে। তাঁর বর্তমান বেতন মাসে ১ হাজার ৫০০ রিয়াল। এ ছাড়া হোটেলের বোর্ডারদের বকশিশ, টিপস পান। তিনি বললেন, এখন বেতনও নিয়মিত পান না। এরপর আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘এই বেতনে বছরে ১২ হাজার রিয়াল যদি দিয়ে দিতে হয়, তাহলে আমি নিজে খাব কী, আর বাড়িতে পাঠাব কী?’

দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে মদিনায় ইলেকট্রনিকসের সামগ্রী ও গিফট আইটেমের ব্যবসা করছেন জামশেদ হোসেন (ছদ্মনাম)। স্ত্রী, তিন সন্তান নিয়ে তাঁর চমৎকার জীবন দেখে এসেছিলাম তিন বছর আগে। মদিনায় মসজিদে নববির কাছেই তাঁর দুটি দোকান। কিন্তু এরই মধ্যে স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন দেশে। কারণ জানালেন, সৌদি সরকারের পরিবার কর (ফ্যামিলি ট্যাক্স) অনেক বেড়ে গেছে। পরিবারের সদস্যপিছু কর এখন দুই হাজার রিয়াল। চার সদস্যের জন্য তাঁকে বছরে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত আট হাজার রিয়াল। জীবনযাত্রার খরচও বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক হারে। আকামার ফিও বেড়েছে। এ ছাড়া ১১ সেপ্টেম্বর থেকে (১ মহররম, আরবি নতুন বছরের শুরু) তাঁর দোকানের মালিকানার ৭০ শতাংশ সৌদি নাগরিককে দিতে হবে। নইলে আর ব্যবসা করতে পারবেন না। বর্তমানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে একজন সৌদি কর্মী রাখার বিধান থাকলেও সেটি কেউ অনুসরণ করে না। প্রবাসীরা নিজেদের ব্যবসা বড় করার সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে ভাই-আত্মীয়দের নিয়ে যেতেন। কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠানটি থাকত একজন সৌদির, যাকে একটি ফি দিলেই চলত।

মদিনায় মসজিদে নববি এলাকার (মার্কেজিয়া নামে পরিচিত) অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালান বাঙালিরা। তাঁদের বড় অংশই চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া এবং কক্সবাজার জেলার বাসিন্দা। অনেকেই ৩০-৩৫ বছর ধরে সেই দেশে আছেন। অনেকের সন্তানদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মক্কা-মদিনায়। এখন তাঁদের মনে হচ্ছে প্রবাসজীবনের পাততাড়ি গোটাতে হবে। সৌদি সরকারের নতুন আইন অনুসারে, কোনো বিদেশি সেখানে এককভাবে ব্যবসা করতে পারবেন না, ব্যবসার কমপক্ষে ৭০ শতাংশের অংশীদারকে সৌদি নাগরিক হতে হবে।

শুধু সৌদি আরবে অন্যান্য দেশের লোকদেরও একই অবস্থা। ভারতের মুম্বাই নিবাসী মেকানিক্যাল প্রকৌশলী বেলাল হোসেন চাকরি করেন কোরীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কিয়াতে। স্ত্রী ও তিন সন্তানকে এ বছরই দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কারণ, ওই ‘ফ্যামিলি ট্যাক্স’। তাঁর কোম্পানি তাঁর পরিবারের কর দেয় না। পাকিস্তানিদের পরিবারের সদস্যদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে বেশ কিছু পাকিস্তানি কমিউনিটি স্কুলশিক্ষার্থীর অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁদের এসবের কারণ জিজ্ঞাসা করলে আঙুল দিয়ে একটি সাইনবোর্ড বা বিলবোর্ড দেখিয়ে দেন। সেখানে ২০৩০ সালের নতুন সৌদি আরব গড়ে তোলার স্বপ্ন ‘ভিশন ২০৩০’- এর ঘোষণা। ওই সময়ে সৌদি আরব প্রয়োজনের অতিরিক্ত একজন বিদেশি কর্মীও রাখতে চায় না। ‘হোয়াইট কালার জবে’ সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বিদেশি থাকতে পারবে। বর্তমানে এ সংখ্যা কোথাও কোথাও ৮০ শতাংশের বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্যের সবটুকু নিজেরাই করতে চায়, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া।

সৌদি সরকার এসবের জন্য সৌদি নাগরিকদের গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। বহুদিনের ‘আলসেমির’ দুর্নাম দূর করে জাতিকে কর্মঠ হিসেবে প্রমাণ করতে চায় তারা। তরুণদের জন্য বেকার ভাতা বাতিল করে দিয়েছে। রাজপরিবার ‘সবাইকে কাজ করে খাওয়ার’ পরামর্শ দিচ্ছে। বেকার ভাতা বাতিল করাতে হাজার হাজার সৌদি তরুণের কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হচ্ছে। তাই তারা বিদেশিদের ‘দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার’ আয়োজন করছে। নিত্যনতুন করারোপ, পুরোনো আইনগুলোর কঠোর প্রয়োগ চলছে। কয়েক দিন মদিনায় থাকাকালে দেখেছি, বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা তল্লাশির ভয়ে দোকানপাট বন্ধ করে দিচ্ছেন। সৌদি সরকারে ‘আজনবি’ (বিদেশি বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত উর্দু শব্দ) খেদানোর এ কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ কিছু দেশকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগে সৌদি আরবে কর্মরত ভারতীয় কর্মীদের মাসিক স্যালারি ট্যাক্স মওকুফও করা হয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছেন বেলাল হোসেন। বেলালের বক্তব্য, তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের ফলে তাঁদের কিছু উপকার হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের পাততাড়ি গোটাতে হবে বলেই তাঁর আশঙ্কা।

তেল আবিষ্কারের পর থেকে সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম প্রবাসী কর্মীদের দেশ। আমেরিকা ও রাশিয়ার পরই বিদেশি কর্মীর সংখ্যায় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ সৌদি আরবে এক কোটির বেশি বিদেশি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ৪০ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সৌদি আরবে কর্মরত। এঁদের বড় অংশই এখন কর্ম ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় পড়েছেন। কেউ কেউ পরিবার-পরিজনকে দেশে পাঠিয়ে দিতে শুরু করেছেন। বাকিরাও একই রকম ভাবছেন। ৩১ বছর ধরে মদিনায় অবস্থান করছেন গাড়িচালক শফিক। চট্টগ্রামের হালিশহরে ছেলেমেয়েদের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। ‘যে কয়েক দিন থাকতে পারি থাকব, না হলে চলে যাব’—এমনটাই ভাবছেন তিনি।

আগামী এক দশকের মধ্যে সৌদি আরবের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্ত আসবে বলে ধারণা করা যায়। এ পরিবর্তনের কেন্দ্রে থাকবে শিক্ষিত ও কর্মঠ সৌদি তরুণসমাজ। গণিত অলিম্পিয়াডের সুবাদে জানি, সেখানে কয়েক বছর ধরে হাইস্কুল থেকে মেধাবী শিক্ষার্থীদের আলাদা করা হচ্ছে। তাদের জন্য আলাদা পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে, থাকছে নিবিড় অনুশীলন। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, ইনফরমেটিকস ইত্যাদি অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ শেষে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় খরচে। পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে বড় আকারের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা অবকাঠামো। অন্যদিকে সৌদি আরব জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পর্যটনকে তাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশ করতে চায়। সে জন্য শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ওপর তাদের নির্ভর করতে হবে। আর এসবের লক্ষ্য তথা ভিশন-২০৩০ নিয়ে বিদেশি কর্মী ও উদ্যোক্তাদের জন্য সৌদি আরবে অবস্থান ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাদের বিদেশি রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ জোগান দেন। তাঁদের অর্ধেকও যদি আগামী এক দশকে দেশে ফিরে আসেন, তাহলে শুধু আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, বেকারত্বও বাড়বে। কিছু নতুন সামাজিক সমস্যাও তৈরি হবে। তাই এখন থেকেই এ বিষয়ে ভাবা দরকার। সৌদি আরবে কর্মরত আমাদের দক্ষ কর্মীদের দেশে ফেরার পর কীভাবে কাজে লাগানো যাবে, উদ্যোক্তারা যদি দেশে ফিরে নিজেদের প্রতিষ্ঠান গড়তে চান, তাহলে তাঁদের কীভাবে সাহায্য করা যাবে, সেসব নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। এ বিষয়ে একটি পরিকল্পনা আমাদের থাকা দরকার।

সৌদি সরকারের ভিশন-২০৩০ যেন কোনোভাবেই আমাদের জন্য ‘ভীষণ’ না হয়ে দাঁড়ায়, তার লক্ষ্যে তৎপরতা শুরু দরকার। যত তাড়াতাড়ি তা করা যাবে, ততই সেটা মঙ্গল।

মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক