রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার

জাতিসংঘের তরফে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর নির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপনের বিষয়টি একটি অসাধারণ অগ্রগতি। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে জ্বলন্ত প্রশ্ন হলো, নিরপেক্ষ ও অভিজ্ঞ হিসেবে খ্যাতিসম্পন্ন তিন বিশেষজ্ঞের তৈরি প্রতিবেদন তারা কীভাবে মূল্যায়ন করবে। কিন্তু তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে চীন ও রাশিয়া কার্যত যেভাবে এই প্রতিবেদনকে অগ্রাহ্য করার মনোভাব ব্যক্ত করেছে, তা বিশ্বমানবতার জন্য গভীর লজ্জার। তারা শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে হতাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও সুইডেনের মতো অনেক দেশই বিচারের সুপারিশকে সমর্থন করেছে, যা আশাব্যঞ্জক।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন যেভাবে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে, তা নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের চোখ নতুন করে খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। জাতিসংঘ এর আগে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নির্যাতনকে এথনিক ক্লিনজিংয়ের (জাতিগত নির্মূল) একটি ‘টেক্সট বুক’ উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আর এবার জাতিসংঘের তরফে একে স্পষ্ট ভাষায় গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর কী ঘটেছে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। আমরা আশা করব, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন এই গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা ও সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসবে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া যাতে তাদের মনোভাব পাল্টায়, সে জন্য তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বসম্প্রদায়কে এটা বলতে হবে, জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি পাল্টা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিয়ে নাকচ করা সম্ভব না হলে মিয়ানমারের অভিযুক্ত জেনারেলদের বিচারের সুপারিশ পাশ কাটানো যাবে না। চীন ও রাশিয়ার বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধনীতির সমালোচনায় এককাট্টা হওয়ার অর্থ এই নয় যে মানবাধিকার সুরক্ষায় বিশ্ববাসী তাদের দুর্ভাগ্যজনক ভূমিকার দিকে চোখ বুজে থাকবে। নিরাপত্তা পরিষদের দুই সদস্যদেশই মিয়ানমারের সঙ্গে ‘সংলাপ’ চালাতে বলছে। আমরা তাদের বলব, শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে সংলাপ নিশ্চয়ই চলবে, কিন্তু গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচার হতেই হবে।

দোষীদের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়টি বিশ্বমানবতার দাবি। পরাশক্তি হলেও তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে চীনের কাছ থেকে একটি অগ্রণী ও যথাযথ ভূমিকা প্রত্যাশিত। চীন একটি উদীয়মান নতুন বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছে। দেশটিকে এটা বিবেচনায় নিতে হবে যে, আইনের শাসন ও ন্যায়পরায়ণতাকে ধুলোয় লুটাতে দিলে সেই বৈশ্বিক উন্নয়ন ভঙ্গুর হতে বাধ্য। ওই প্রতিবেদনে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, ওই গণহত্যা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচার্য। আর তা নিশ্চিত করতে হলে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হতে হবে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা আগেও একমত ছিলেন; কিন্তু জাতিসংঘের নিজস্ব অবস্থানের আইনি ভিত্তিটা এত দিন অতটা জোরদার ছিল না। যদিও এর আগে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, গণমাধ্যম গণহত্যার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল বলেই নির্দেশ করে আসছিল। এখন সেটা আরও বেশি নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব হলো।

বাংলাদেশকে এখন অত্যন্ত সক্রিয় কূটনীতি শুরু করতে হবে। তাকে পরিষ্কার করতে হবে যে বাংলাদেশ শুধু অপরাধীদেরই বিচার দাবি করে। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে একটি নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রত্যাবাসনসহ অন্য যত আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে, সেটা তার চালিয়ে নিতে কোনো অসুবিধা নেই। মিয়ানমারকেও বুঝতে হবে যে, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, তারা চূড়ান্ত বিচারে দেশপ্রেমিক নয়, নির্দয় ক্ষমতাপ্রেমী। আর সভ্য রাষ্ট্র হতে চাইলে অভিযুক্ত ছয় জেনারেলের বিচারের দাবির বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। তাঁদের এখনই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

আমরা ফেসবুকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানসহ অভিযুক্ত জেনারেলদের নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। আশা করব, বিশ্বের সব সামাজিক সংগঠন একই ধরনের পথ অনুসরণে ব্রতী হবে।