কে সঠিক, ওবায়দুল কাদের না শাজাহান খান?

ওবায়দুল কাদের ও শাজাহান খান।
ওবায়দুল কাদের ও শাজাহান খান।

কয়েক দিন আগে পত্রিকার একটি খবর কৌতূহল জাগিয়েছিল। খবরটি হলো নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান নারায়ণগঞ্জে এক সমাবেশে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রাথমিকভাবে আগামী নির্বাচনে ১০০ আসনে প্রার্থীতালিকা করেছে। তার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের নাম রয়েছে।

যেকোনো নির্বাচনে দলের মনোনয়ন ঠিক করে থাকে মনোনয়ন বোর্ড। শাজাহান খান মন্ত্রী হলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য নন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মনোনয়ন বোর্ডে অন্যদের মধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সভাপতি মণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা কেউ মনোনয়নের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কথা বলেননি। তাহলে নৌপরিবহনমন্ত্রী কোন সূত্র থেকে খবরটি পেলেন?

যেখানে আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগে প্রচণ্ড ঝড় বইছে, সেখানে একজন মন্ত্রী এক প্রার্থীর নাম আগাম ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এমন সময়ে তিনি ঘোষণাটি দিলেন, যার কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়, ত্বকী হত্যাকারী বা তাদের প্রশ্রয়দানকারীদের যেন আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া না হয়।

নাগরিক সমাজের দাবির সঙ্গে মন্ত্রীর ঘোষণার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটি ভেবে দেখা প্রয়োজন।

মেধাবী কিশোর ত্বকীকে কে বা কারা খুন করেছে, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। এ ব্যাপারে তদন্তকাজে কিছু অগ্রগতিও হচ্ছিল। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার দুই আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন, যা সে সময়ে সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, ত্বকী হত্যার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা জড়িত। এরপর অজ্ঞাত কারণে ত্বকী হত্যার তদন্ত থেমে যায়। ত্বকী হত্যার অনেক পর নারায়ণগঞ্জে যে সাত খুনের ঘটনা ঘটে, নিম্ন আদালতে তার বিচারও হয়েছে।

এই অবস্থায় নারায়ণগঞ্জে কাউকে নির্বাচনে আগাম প্রার্থী ঘোষণা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রীর এই ঘোষণার তিন দিন না যেতেই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী সাফ বলে দিলেন, ১০০ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ঠিক করেছে বলে যে খবর বের হয়েছে, তা সত্য নয়। তাঁর মতে, প্রার্থী চূড়ান্ত করার এখতিয়ার একমাত্র দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনি কোনো প্রার্থী ঠিক করলে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁর জানার কথা। অতএব ১০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করার খবরটি সত্য নয়।

দেখা যাচ্ছে, দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী দুই রকম কথা বলেছেন। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, ১০০ প্রার্থী ঠিক করা হয়েছে, যার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের নাম আছে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগ এখনো কোনো প্রার্থী ঠিক করেনি। তালিকাও তৈরি করেনি। তাহলে কার কথা ঠিক?

শাজাহান খানের কথা ঠিক হলে ওবায়দুল কাদের বেঠিক প্রমাণিত হয়ে যান। আর ওবায়দুল কাদের ঠিক হলে শাজাহান খান বেঠিক হয়ে যান। তাঁরা দুজনই প্রভাবশালী মন্ত্রী হলেও ওবায়দুল কাদেরের বাড়তি সুবিধা হলো তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক। দলীয় প্রধান তাঁকে দিয়েই সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সে ক্ষেত্রে দলের হাঁড়ির খবর তাঁরই বেশি জানার কথা।

প্রার্থীর মনোনয়ন ঠিক করে মনোনয়ন বোর্ড। আগামী নির্বাচন নিয়ে মনোনয়ন বোর্ডের কোনো বৈঠক হয়েছে বলেও আমাদের জানা নেই। আর অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হলেও দলের সাধারণ সম্পাদকেরই জানার কথা।

তাহলে নৌপরিবহনমন্ত্রী আগাম একজন প্রার্থীর নাম কেন বললেন? এর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, সেখানে শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে একটি শক্তিশালী গ্রুপ আছে, যারা বিকল্প প্রার্থীর কথা ভাবছে। তাদের তৎপরতা বন্ধ করতে এটি মন্ত্রীর কৌশল হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আগেভাগে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করলে তিনি রাজনৈতিক ফায়দা পেতে পারেন। বিরোধী পক্ষকে দেখানো যে তৃণমূল থেকে যে তালিকাই দেওয়া হোক না কেন, কেন্দ্র আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। আগে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে স্থানীয় কমিটির কাছে সম্ভাব্য প্রার্থীতালিকা চাওয়া অর্থহীন।

আমাদের মনে আগে, বিগত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য মেয়রপ্রার্থীদের তালিকায় সেলিনা হায়াৎ আইভীর নাম ছিল না। কিন্তু দলীয় নীতিনির্ধারকেরা তাঁকেই মনোনয়ন দিয়েছেন এবং তিনি জয় ছিনিয়ে এনেছেন। অন্যান্য স্থানে ভোট কারচুপি হলেও নারায়ণগঞ্জে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনেই সেলিনা হায়াৎ আইভী দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র হয়েছেন। এর আগে তিনি পৌরসভারও নির্বাচিত মেয়র ছিলেন। ২০১৩ তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শামীম ওসমান প্রায় এক লাখ ভোটে হেরেছিলেন।

এর আগে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনেও শামীম ওসমান বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন এবং দেশত্যাগ করেন। শামীম ওসমান দেশে ফিরেছেন ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে। যদিও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী দেশে থেকেই বিএনপি আমলে জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। শামীম ওসমান নিজেকে সাচ্চা আওয়ামী লীগার বলে দাবি করেন। কিন্তু তাঁর মতো সাচ্চা আওয়ামী লীগার কীভাবে সহযোদ্ধা ও কর্মীদের বিপদে ফেলে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারলেন। ভবিষ্যতেও বিপদে পড়লে যে পালাবেন না, তারই-বা নিশ্চয়তা কী।