কল্যাণ রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ যেভাবে সম্ভব

বাংলাদেশে ধীরে ধীরে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র বেড়ে উঠছে। স্বাধীনতার পরপর সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ও রিলিফভিত্তিক কিছু খাদ্য কর্মসূচি ছাড়া কল্যাণ রাষ্ট্রের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উপকরণ ছিল না। সত্তর ও আশির দশকে উদীয়মান এনজিও আন্দোলন ও বৈদেশিক দাতা সংস্থাসমূহের তৎপরতায় সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক উন্নয়নের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেতে শুরু করলেও রাষ্ট্রের ভূমিকা তখনো যৎসামান্যই ছিল।

মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে রাষ্ট্র নাগরিকের কল্যাণে অধিকতর দায়িত্ব নিতে শুরু করে। তখনই বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতার মতো কর্মসূচিগুলো চালু হয়। পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মেয়েদের জন্য বৃত্তি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বই বিতরণ শুরু হয়। এসব কর্মসূচির আওতা ও সুবিধার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং সমাজের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে লক্ষ করে নতুন নতুন কর্মসূচি যোগ হতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় অর্ধশতাধিক কর্মসূচি চালু আছে। দেশের মোট জিডিপির ২ শতাংশের মতো এখন সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ব্যয় হয়।

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতাধীন কর্মসূচিগুলো মূলত আর্থিক সহায়তাভিত্তিক। কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্রে সাধারণত তিন ধরনের উপকরণ থাকে: উপার্জন-সহায়তা, সামাজিক সেবা ও আইনি নিরাপত্তা। উপার্জন-সহায়তার দিকটি ধীরে ধীরে বিকশিত হলেও সামাজিক সেবা ও আইনি নিরাপত্তার দিকগুলো এখনো অনুন্নত ও সংকীর্ণ। বৃহত্তর বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষা, সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা ও সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রতিবন্ধী ও এতিমদের জন্য পরিচালিত কিছু পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচি ছাড়া কল্যাণমূলক সামাজিক সেবা কর্মসূচি আমাদের দেশে তেমন নেই। তা ছাড়া আর্থিক ও সেবা খাতের কর্মসূচিগুলোও মূলত অ্যাডহক ও প্রকল্পভিত্তিক, অধিকারভিত্তিক নয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে অধিকারভিত্তিক করতে হলে টেকসই ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রয়োজন হয়। কেননা, তখন এসব প্রবিধান নাগরিকের কল্যাণে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গীকারের বিষয় হয়ে যায়। এরূপ প্রাতিষ্ঠানিক অঙ্গীকারের আলোকেই উন্নত বিশ্বের কল্যাণ রাষ্ট্রসমূহ সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকে।

প্রতিটি দেশের কল্যাণব্যবস্থাই সে দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এবং সে দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক সমস্যার নিরিখে বিকশিত হয়। আমাদের উঠতি অর্থনীতি; তাই আমাদের সামাজিক সমস্যা ও তাদের আপেক্ষিক গুরুত্ব ও প্রাধিকার এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকেই রাষ্ট্রীয় পুনর্বণ্টন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের কথা ভাবতে হবে। এর নিরিখেই দুটি সমস্যার বিষয়ে এখানে আলোকপাত করতে চাই। প্রথমটি শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র সম্প্রসারণবিষয়ক এবং দ্বিতীয়টি প্রবীণ পরিচর্যার বিষয়ে।

প্রথম সমস্যাটি নিয়ে ইতিমধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কর্মস্থলভিত্তিক দিবাযত্নকেন্দ্রের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু পোশাকশিল্প ছাড়া আর কোথাও কর্মস্থলভিত্তিক দিবাযত্নকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া নগরজীবনের প্রাত্যহিক যানজট, পরিবহনস্বল্পতা, অপেক্ষা, অনিশ্চয়তা, ওঠা-নামার দুর্ভোগ, ঠাসাঠাসি, যাত্রীছাউনির অনুপস্থিতি ও অব্যবহার্যতা এবং আবাসস্থল থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব বিচারে, বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে কর্মস্থলভিত্তিক দিবাযত্নকেন্দ্রের যথার্থতা প্রশ্নসাপেক্ষ।

অন্যদিকে, নারীশিক্ষা প্রসারের পাশাপাশি শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশের প্রত্যাশা বেড়েছে। সেখানে নারীর প্রবেশের হার এখন পুরুষের চেয়ে বেশি। তবু দেশের কর্মক্ষম নারীর মাত্র ৩৬ ভাগ এখন শ্রমবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। টেকসই ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষ শ্রমের জোগান নিরবচ্ছিন্ন করার প্রয়োজনে ক্রমবর্ধমান হারে শ্রমবাজারে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নারীর অংশগ্রহণের আবশ্যকতা অনস্বীকার্য।

অধিকন্তু, এর সঙ্গে নারীর প্রতি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিও জড়িত। মেয়েরা এখন কেবলই শিক্ষিত মা হওয়ার জন্য পড়াশোনা করেন না। তাঁরা কর্মজীবনে ঢুকতে চান এবং পারিবারিক অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে চান। এ ক্ষেত্রে সন্তান লালন-পালন একটি বড় বাধা। মাতৃত্বের কারণে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নারীর গৃহাবস্থান ব্যক্তিগত হতাশা এবং পারিবারিক অস্থিতিশীলতাও তৈরি করে। তাই শ্রমবাজারে নারীর প্রবেশ ও টিকে থাকা অবাধ ও নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে দিবাযত্নকেন্দ্র সম্প্রসারণে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এককভাবে দায়িত্ব নিতে পারে অথবা বেসরকারি খাতের সহায়তা নিতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয়টি এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত। কিন্তু তার তাৎপর্য অনুধাবন আবশ্যক। কর্মজীবন শেষে মানুষ যখন প্রবীণ ও দুর্বল হতে থাকে এবং বার্ধক্যজনিত নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, তখন তাঁরা সেবা ও পরিচর্যার জন্য ক্রমে পরনির্ভরশীল হতে থাকেন। প্রচলিতভাবে আমাদের সমাজে পরিবারই প্রবীণ পরিচর্যার দায়িত্বটি পালন করে এসেছে। কিন্তু পরিবারের কাঠামোগত পরিবর্তন, কখনো সন্তানস্বল্পতা বা সন্তানদের শহর কিংবা বিদেশমুখিতা অথবা অনাগ্রহের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার এখন আর তার প্রচলিত দায়িত্ব পালনের উপযোগী নয়।

২০১৩ সালের পিতা–মাতা রক্ষণাবেক্ষণ আইন প্রবীণ সেবার ভার পরিবারের ওপরই চাপিয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ওপরে উল্লেখিত সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচিত হয়নি। অধিকন্তু এ আইনে অনেক প্রবীণ যেমন সৎমা ও সৎদাদির রক্ষণাবেক্ষণ এবং বার্ধক্যকালীন প্রাত্যহিক পরিচর্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তাই একদিকে পারিবারিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে আইনি নিরাপত্তার অপর্যাপ্ততার ফলে বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে অনেক প্রবীণ মানুষ যথাযথ সেবা ও পরিচর্যা না পেয়ে অযত্ন ও অবহেলায় বার্ধক্য জীবনযাপন শেষে মৃত্যুবরণ করেন। এমনকি উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতেও সন্তানদের অনুপস্থিতিতে প্রবীণ মানুষেরা কখনো কখনো গৃহকর্মীদের দ্বারা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থিক নিগ্রহের শিকার হন।

বাংলাদেশে গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর আকার ক্রমেই বাড়ছে। কর্মজীবনের শেষে প্রতিটি প্রবীণ মানুষ সম্মানজনক জীবন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনাবসান দাবি করতে পারেন। রাষ্ট্রকে তাই প্রবীণ পরিচর্যার বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে প্রচলিত সিনিয়র রেসিডেন্স ও পার্সোনাল কেয়ার হোমের আলোকে পরিবারের বিকল্প বা পরিপূরক কাঠামোর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এভাবে শিশুর দিবাযত্ন ও প্রবীণ পরিচর্যা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পেলে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর যেমন সুরাহা হবে, তেমনি রাষ্ট্রীয় সামাজিক সেবা খাতের সম্প্রসারণের ফলে বাংলাদেশে কল্যাণ রাষ্ট্রের বিকাশ আরও ভারসাম্যপূর্ণ হবে।

ড. মো. মাহমুদুর রহমান ভূঞা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক