আবার আপনাকে বিদায়, জাহাপঁনা

বাংলার ইতিহাসের ভাগ্যহত নায়ক নবাব সিরাজ উদ–দৌলাকে মনে নেই যার, তারও মনে পড়বে সিনেমার নবাব আনোয়ার হোসেনকে। ইতিহাসের সেই নবাবের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলেন অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। একজন বাস্তবের নবাব, অন্যজন মানুষের মনের নবাব। সিরাজের জীবনকেই আমরা তাঁর জীবন বলে মেনে নিয়েছি যখন, সিরাজের হতাশা ও আক্ষেপকে যখন আনোয়ারের আবেগে থরথর কণ্ঠ আর অভিনয় দেখে বিশ্বাস করেছি, তখন আর পর্দার পেছনে আনোয়ার হোসেন কেমন, তা জানার আগ্রহ হবে কেন? হয়ওনি। সিরাজ চরিত্রের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে এভাবেই আনোয়ার হোসেন হয়ে উঠেছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের প্রতিকৃতি। মানুষের মনে চিরকাল করুণ বীরের প্রতি যে ভালোবাসা কাজ করে, আনোয়ার হোসেন তাঁর অসাধারণ আন্তরিক অভিনয় দিয়ে দর্শকের মনে সেই সুপ্ত নহর জাগাতে পেরেছিলেন। তিনি যখন গলা কাঁপিয়ে সংলাপ দিতেন, ‘আমিই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা’; মানুষের মনে বিশ্বাস আর সমীহ দুটোই জাগ্রত।

আনোয়ার হোসেন কালজয়ী আরও সিনেমায় অভিনয় করে ভালবাসা পেয়েছেন। সূর্যস্নান, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, জীবন থেকে নেয়া, অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী, গোলাপী এখন ট্রেনে’র মতো স্মরণীয় ছবিগুলোর অভিনেতা হিসেবে আনোয়ার হোসেনকে মনে পড়বে আগামির দর্শক ও গবেষকের। কিন্তু নবাব সিরাজের চরিত্রে তিনি অতুলনীয়—যেমন অতুলনীয় অভিনয় টিনের তলোয়ার নাটকে উৎপল দত্তের। সত্যিকার সিরাজ কেমন ছিলেন, তা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা তর্ক করেন, কিন্তু তাঁর প্রজন্মের মানুষের মনের নবাব আনোয়ার হোসেন। যাঁরা তাঁর অভিনয় দেখেছেন, শুনেছেন সেই হৃদয় বলকানো সংলাপ: ‘বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব। তুমি বলেছিলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের প্রশ্রয় দিয়ো না, তুমি বলেছিলে সুযোগ পেলেই তারা এ দেশ কেড়ে নেবে, আমি তাদের প্রশ্রয় দেব না’; তাঁরা ভেবেছেন সিরাজই আনোয়ার, আনোয়ারই সিরাজ। জেনেছেন কিসের জন্য সিরাজ জীবন দিয়েছেন। ইতিহাসের সিরাজের মধ্যে এভাবে মিশে গেছেন সিনেমার আনোয়ার হোসেন। শিল্পের কাছে জীবনের এমন বিসর্জন বিরল। এভাবে আনোয়ার মনে করিয়ে দেন ফরাসি স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণী জোয়ান অব আর্ক চরিত্রে অভিনয়কারী ইনগ্রিড বার্গম্যানকে। সে এমনই অভিনয়, দর্শকেরা তো বটেই, বার্গম্যান নিজেও বহুদিন জোয়ান অব আর্ক চরিত্রের ঘোর থেকে বেরোতে পারেননি। তাঁর অভিনীত মঞ্চনাটকেও জোয়ান অব আর্ক জীবন্ত প্রতিমা হয়ে উঠত। আনোয়ার হোসেনও তেমনি নিজস্ব ইমেজে জাগিয়ে তুলেছিলেন সিরাজের জীবনকে। কৃষকচেতনার বাংলাদেশে সফল নায়কদের চেয়ে ট্র্যাজিক বীরেরা বেশি সহানুভূতি পান। আনোয়ার হোসেন সেই সহানুভূতি জাগাতে পেরেছিলেন।

বাংলা সিনেমার আধুনিকতা এবং দেশজতার যুগসন্ধিক্ষণের নায়ক আনোয়ার হোসেন। উর্দু ও হিন্দি ছবির সঙ্গে কোনোভাবেই যখন পেরে ওঠার কথা নয় দেশভাগের পরের ঢাকার সিনেমার, তখন বাংলা সিনেমা নিল যাত্রার আদল এবং যাত্রার অভিনয়ের শৈলী। এই শৈলীরই শ্রেষ্ঠ রূপায়ন ঘটান আনোয়ার হোসেন। তাতেই বাজিমাত। ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্প হিন্দি ও উর্দুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকল না শুধু, তা গ্রামীণ বাংলার দর্শকের মেজাজের সঙ্গে মিশে জাতীয় আখ্যান হয়ে উঠল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক রসায়ন তৈরিতে এর ভূমিকা কম না। ঢাকার প্রথম আধুনিকতা তাই গ্রাম–শহরের বিচ্ছেদের ভুলটা করেনি। বরং তা লোকায়ত মনের আবেগে মিশে ভিন্ন এক মানসিকতার জন্ম দিয়েছিল। শহুরে সংস্কৃতির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে এই ঘটনার অবদান যেমন কম না, তেমনি আনোয়ার হোসেনের অভিনয়–শৈলীর জাদুর কথাও মনে রাখতে হবে।

জাতীয়তাবাদ বীর চায়, নিপীড়িত জাতি নায়ক চায়, জনগণ চায় ট্র্যাজিক মিথের পুনর্জাগরণ। নবাব সিরাজ চরিত্র এই তিনের অভাব অন্তত তিনবার মিটিয়েছে। ইতিহাসে তিনবার বেঁচে ছিলেন তিনি। একবার নিজের জীবনে, দ্বিতীয়বার বিশ শতকের শুরুর কলকাতায় গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক সিরাজউদ্দৌলায় এবং তৃতীয়বার চলচ্চিত্রে। ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের তুঙ্গে বাঙালির তখন একজন জাতীয় বীর ও দেশপ্রেমিক নায়কের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। গিরিশচন্দ্র তাঁকে নিয়ে এলেন মঞ্চে। নাটকের মঞ্চ হয়ে উঠল জাতীয় রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ। বিপুল জনপ্রিয় ওই নাটক জনমনে সিরাজের বদনাম মুছে দিল। তাঁকে নিয়ে সারা বাংলায় রচিত হলো অজস্র যাত্রাপালা। কলকাতায় ইংরেজদের সিরাজ-বিদ্বেষের প্রতীক মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলওয়েল মনুমেন্ট ভাঙার ডাক দিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সেই আন্দোলনে অজস্র তরুণ প্রাণ দিলেন। সিরাজ আবার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন।

সিরাজের আবার ডাক পড়লো পাকিস্তান আমলের বাংলাদেশে। জাতীয়তাবাদী আবেগ একটা মুক্তিকামী প্রতীক চাইছিল। খান আতার সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্র সেই অভাব মেটাল। সিরাজ হয়ে উঠলেন একজন দেশপ্রেমিক, দরদি ও সাহসী শহীদ। নতুন একগুচ্ছ যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হতে থাকল তাঁর নামে। তরুণ অভিনেতা আনোয়ার হোসেন যেন সিরাজের অবতার হিসেবে দেখা দিলেন। মানুষের মনে আবেগের জোয়ার বয়ে গেল। বীরত্বে শুরু আর অশ্রুতে শেষ সেই কাহিনির পাতা থেকেই যেন উঠে এলেন তিনি। নবাব সিরাজের পুনর্জন্ম হলো। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শচীন সেনগুপ্ত কিংবা সিকান্দার আবু জাফরের সিরাজউদ্দৌলা নাটকে সিরাজের সংলাপে এই আকুতিই ফুটে উঠেছিল। পরাজয়ের মুখে সিরাজ বলছেন, ‘গোলাম হোসেন, আমি আবার সৈন্য সংগ্রহ করব, আবার যুদ্ধ করব, এই জন্মে না পারি, জন্ম-জন্মান্তরে এই কলঙ্ক আমরা দূর করব।’ জন্ম-জন্মান্তরে পরাধীনতার কলঙ্ক দূর করতে সিরাজ এসেছিলেন আনোয়ার হোসেনের বেশে। দেশপ্রেমের ভাবোচ্ছ্বাসে সংগ্রামের পালে হাওয়া লাগল, অনেকের সামনে হাজির হলো দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের আদর্শ উদাহরণ।

সিরাজের এই তৃতীয় প্রত্যাবর্তন কিছুতেই সম্ভব ছিল না আনোয়ার হোসেনের সেই নাটকীয়, উচ্ছ্বসিত ও তেজস্বী অভিনয় ছাড়া। লোকে সিরাজকে আবার নতুন করে পেল, এই পাওয়ার মধ্যে নন্দিত হলেন আনোয়ার হোসেন, কিন্তু একই সঙ্গে সিরাজ চরিত্রের মধ্যে নিজের নিজস্বতাকেও বিলীন করে দিলেন। অভিনয়ের বাইরে যেখানেই তিনি হাজির হয়েছেন, লোকে ভেবেছে ওই যে কথা বলে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। আনোয়ার হোসেন তাই কেবল একজন বড় মাপের শিল্পী নন, আবেগ-জাগানিয়া অভিনেতা নন; তিনি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামেরও অংশ। এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের দুর্দশার আবহে তাঁর কাঁপানো গলার ডাক কান পাতলেই শোনা যাবে।

সেলিব্রিটি কথাটা এখন দারুণ চালু। নাম-ধাম-খ্যাতি-বিত্ত-ডাঁট তাঁদের মানুষের থেকে স্বর্গীয় দূরত্বে ঠেকিয়ে রাখে। তাঁরা অসাধারণ এবং দূরের। আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম অভিনেতা হয়েও সেলিব্রিটি ছিলেন না। ছিলেন ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষ। তাই তাঁর মৃত্যুতে মহানায়কের প্রয়াণের সমতুল্য শোক জাগতে দেখা যায়নি; বরং দেখা গেছে কাছের কাউকে বিদায় জানানোর মিহি বেদনা। মনে পড়ছে তাঁর ঐতিহাসিক যমজ সিরাজউদ্দৌলাকেও। চলচ্চিত্রে, হত্যাকারীর খঞ্জরে রক্ত ঝরাতে ঝরাতে সিরাজ অন্তিম হাহাকার করে বলেছিলেন, ‘হায় রে দুর্ভাগা দেশ’! চিকিৎসার অর্থের অভাব, শেষ জীবনে সহায়-স্বীকৃতির অভাবে সিরাজের মতোই আনোয়ারও কি মৃত্যুর আগে দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন, ‘হায় রে দুর্ভাগা দেশ!’ এই ভালোবাসার মানুষেরা হৃদয় পায়, প্রতিষ্ঠা পায় না। বাংলার মাটির নবাব আনোয়ার হোসেনও সেটাই জেনে গেলেন।

মৃত্যুর ৫ বছর পর আপনাকে পুনরায় বিদায় অভিবাদন জানাই, জাহাঁপনা!

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]