মনোযোগ নষ্ট করার জন্য এই দমন-পীড়ন

ভারতে সরকারের বিরোধী ও সমালোচকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
ভারতে সরকারের বিরোধী ও সমালোচকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল সংবিধানের ধারা মেনে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারা অনুযায়ী এই জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়েছিল। প্রায় দুই বছর ধরে চলা সেই জরুরি অবস্থার সময় সরকারের বিরোধীদের ধরে ধরে জেলে পোরা হয়েছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে হরণ করা হয়। আর এখন ভারতে যা চলছে, তা জরুরি অবস্থার চেয়ে কম নয়। সরকার সমানে বেআইনি কাজ করে চলেছে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং এ নিয়ে কোনো ঢাক ঢাক গুড় গুড়ও নেই। সবচেয়ে খারাপ যে বিষয় তা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের সব ধরনের অপকর্মকে সরকার সায় দিচ্ছে। এই ধারণা দেওয়া হচ্ছে যে তাদের ওপর রাষ্ট্রের আশীর্বাদ আছে।

সরকারের বিরোধী ও সমালোচকদের তাঁদের মৌলিক অধিকারগুলোর চর্চা করতে দেওয়া হচ্ছে না। তাঁদের দমন করা হচ্ছে এবং শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের বাড়িঘরে পুলিশি অভিযান চালানো হচ্ছে এবং গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এগুলো সরকারের নির্দয় আচরণ। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে দুজন গত ৩১ ডিসেম্বর পুনেতে অনুষ্ঠিত এলগার পরিষদের সম্মেলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। লেখক-সাহিত্যিকদের নিয়ে এটা ছিল এলগার পরিষদের দ্বিতীয় সম্মেলন। প্রথম সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ৪ অক্টোবর একই স্থানে। বর্তমান সরকারের অসাংবিধানিক আচরণের নিন্দা, প্রতিবাদ জানাতে এবং সংবিধান প্রয়োগের দাবিতে ওই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। ডিসেম্বরের সম্মেলনে কবির কালা মঞ্চ (কেকেএম) নামে একটি প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়। এতে অনেকে বক্তৃতা করেন। তাঁরা সবাই সরকারের বেআইনি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেন এবং সংবিধান মেনে কাজ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। সম্মেলন শেষে সবাই একত্র হন এবং শপথ নেন যে বর্তমান সরকার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা কোনো বিশ্রাম নেবেন না।

সম্মেলন অনুষ্ঠানের পাঁচ মাস পর গত ৬ জুন পুলিশ কেকেএমের সদস্যদের বাড়িতে অভিযান চালায়। তাঁরা মাওবাদী বা মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল—এই অজুহাতে তাঁদের বাড়িঘরে অভিযান চালানো হয়। গত ২৮ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বলা হয় যে তাঁরা সবাই মাওবাদী এবং সরকারকে উৎখাত করতে চাইছেন। শুধু এটাই নয়, তাঁরা এলগার পরিষদের সম্মেলন আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সম্মেলনের মাধ্যমে মাওবাদীদের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, সুধীর ঢাওলে ও সোমা সেন ছাড়া আর কারও এলগার পরিষদের সম্মেলনের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বা কেউ সম্মেলনে যোগ দেননি। আমরা তাঁদের চিনিও না। এতে বোঝা যায়, এঁদের গ্রেপ্তার পরিষ্কারভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মনে হচ্ছে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডে জনগণ যে ক্ষুব্ধ হয়েছে, তা থেকে তাদের মনোযোগ সরানোর জন্য সরকার এসব করছে। তবে আরেকটি কারণেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, সম্প্রতি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘সনাতন সংস্থা’র বিরুদ্ধে জনগণকে আতঙ্কিত করার জন্য বোমা তৈরি ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের চক্রান্ত ফাঁস হয়েছে। এই ঘটনা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্যও এঁদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর পৃষ্ঠপোষক হওয়ার কারণে সরকার সব সময় হিন্দুত্ববাদীদের সহিংস কর্মকাণ্ড থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নিতে আগ্রহী, যারা কিনা এখন দেশে সহিংস তৎপরতা চালাচ্ছে—এটা স্পষ্টভাবেই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে উৎসাহিত করা। পুলিশ এখন ব্যস্ত গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে সহিংস কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাতের চেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করতে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে যে আমাদের একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান আছে, যা জনগণকে ব্যালটের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করার অনুমতি দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা সরকার উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন কি না, তা সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত নির্ধারণ করবেন। এখন এ ব্যাপারে কোনো কিছুই বলার দরকার নেই।

প্রকৃতপক্ষে সরকারের এসব স্বৈরাচারী ও নিপীড়নমূলক আচরণ জনগণের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে। যদিও বর্তমান সরকারকে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছে না, তবু তাদের সংবিধান মানতে হবে। সংবিধানের পরিবর্তন ছাড়া নিজেদের আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার দেশকে গণতান্ত্রিক থেকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে না।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া।

পি বি সাওয়ান্ত: ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক