এবারের নির্বাচন মানুষের আস্থা ফেরানোর সুযোগ

অস্থিতিশীলতা মাথাচাড়া দেওয়ায় আগামী ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সম্ভাব্য নির্বাচনের পর পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা বেশ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) বাংলাদেশে পরিচালিত নতুন জনমত জরিপে এমন কিছু গতিবিধি স্পষ্ট হয়েছে, যা আগামী নির্বাচনের প্রচারণা, এর ফলাফল এবং নির্বাচন-পরবর্তী স্থিতিশীলতার প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিতে পারে।

জনমত জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন। গণতন্ত্রের ওপর মানুষের আস্থা ফেরাতে আগামী নির্বাচন সব কটি রাজনৈতিক দলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে হাজির হচ্ছে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, আইআরআইয়ের জরিপ থেকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। জরিপে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেড়েছে উল্লেখ করে বলেছেন, দেশ ঠিক পথে এগোচ্ছে। ৬৯ শতাংশ নাগরিক দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ‘কিছুটা ভালো’ অথবা ‘খুবই ভালো’ বলে মনে করেন তাঁরা।

২০১৭ সালের এপ্রিলে করা আইআরআইয়ের জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এসব সংখ্যা এবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে—১২ মাসের ব্যবধানে এমন মত প্রদানকারীর অনুপাত কমেছে ১৩ পয়েন্ট। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ‘খুবই ভালো’ মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে অনুপাত কমেছে যথাক্রমে ২৬, ২৭ ও ১৯ পয়েন্ট। সেনাবাহিনী, পুলিশ, উচ্চ আদালত, নির্বাচন কমিশনসহ দেশের বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে। দেশের সবচেয়ে বড় একক সমস্যা কী—এ প্রশ্নের জবাবের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ‘দুর্নীতি’ (২১ শতাংশ) এবং ‘অর্থনীতি’ (১৬ শতাংশ)।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ প্রবলভাবে গণতন্ত্রকামী। তবে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেবল ৫১ শতাংশ বলেছেন, দেশের গণতন্ত্র ‘কিছুটা ভালো’ অথবা ‘খুবই ভালো’। আগামী সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন—এমন সম্ভাবনার কথা বলা মানুষের সংখ্যা ১৮ পয়েন্ট কমে ৫৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাত্র ৩২ শতাংশ বলেছেন, নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে। বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী হয় বলেছেন এখনই তাঁরা কিছু বলতে পারছেন না, নয়তো মত দিতে অপারগ।

২০১৭ ও ২০১৮ সালের জরিপের মধ্যবর্তী সময়ে, গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে জনমতবিষয়ক আইআরআইয়ের ফোকাস গ্রুপ আলোচনায় (এফজিডি) প্রাপ্ত তথ্যগুলোই সাধারণভাবে এ জনমত জরিপে প্রতিফলিত হয়েছে। এফজিডির তথ্যে দেখা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠান, গণতন্ত্র ও অর্থনীতি নিয়ে জনগণ উদ্বিগ্ন। সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক ব্যক্তি বলেন, ‘পুলিশের দায়িত্ব হলো দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা। কিন্তু সাধারণ মানুষকে তারা দুর্ভোগে ফেলছে। নিরপরাধ মানুষের কাছ থেকে তারা ঘুষ নিচ্ছে।’ বরিশালের প্রত্যন্ত এলাকার এক নারী বলেন, ‘সবকিছু এখন চলছে মানুষের মতামতের তোয়াক্কা না করে। গণতন্ত্র থাকলে আমরা ভোট দিতে পারতাম।’

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার এক নারী বলেন, ‘এখন চাকরির আর কোনো সুযোগ নেই। কেউ চাকরি পাচ্ছে না।’ আর রংপুর শহরের এক মানুষ দাবি করেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয় ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আগে যেভাবে ব্যবসা করতে পারতাম, এখন আর সেভাবে পারছি না। কিছু রাজনীতিক আমাদের যন্ত্রণা দেন। যন্ত্রণা মানে, তাঁরা চাঁদা চান। চাঁদা দিতে না চাইলে হুমকি দেন। কাজেই চাঁদা দিতে আমরা বাধ্য।’

মোটের ওপর বাংলাদেশে আইআরআইয়ের গত বছরের জনমত জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, সরকারি চাকরি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতি নিয়ে যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা এখন নিম্নগামী। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিঃসন্দেহে আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণার সময় রাজনৈতিক বিতর্কের প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেবে। কারণ, সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজেদের সাফল্য নিয়ে হাজির হবে, আর বিরোধী দল ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবে।

ডিসেম্বরের নির্বাচনে যারাই জিতুক না কেন, মানুষের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ প্রতিহত করা এবং গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সরকারি কর্তাব্যক্তিদের কাছে এ নির্বাচন উৎসবমুখর ও সহিংসতামুক্ত এবং অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা একটি সুযোগ হিসেবে এসেছে।

[লেখাটি গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে]

স্টিভ চিমা: যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক ও নির্দলীয় সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার আবাসিক প্রকল্প পরিচালক।

জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড: আইআরআইয়ের গণতন্ত্র ও শাসনপদ্ধতি-বিষয়ক গবেষক।