দুর্নীতি, খেলার পদক এবং অতি ধনী

সুখবর হলো বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা বাড়ছে এত দ্রুত হারে যে আমরা দুনিয়ার সব দেশের ওপর টেক্কা মেরেছি। কোনো তালিকাতেই এই দেশের ভাগ্যে প্রথম স্থান জোটে না। এই প্রথমবার আমাদের প্রথম স্থান জুটেছে। তদুপরি ব্যাপারটি চাট্টিখানি নয়, অতি ধনীদের ব্যাপারে। অতএব রয়েসয়ে, বুঝেশুনে কথা বলতে হবে। এদের প্রত্যেকের সম্পত্তির পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকার বেশি। এত টাকা বস্তায় ভরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে নিতে হলে বস্তা লাগবে কতটি, বস্তা বহনের জন্য কাভার্ড ভ্যানের কী হিসাব—এসব সুখচিন্তা ও দিবাস্বপ্নে এই অধম লেখক এবং হয়তো কিছু গোবেচারা পাঠক মশগুল হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলাদেশের কারা, কীভাবে ২৫০ কোটি টাকার সম্পত্তির পাহাড় গড়েছে এবং তাদের সংখ্যা বিশ্বের অন্য কোনো দেশের তুলনায় কীভাবে বাংলাদেশে বাড়ছে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে।

একদিকে ২৫০ কোটি টাকা, অন্যদিকে পোশাকশ্রমিকদের ভীষণভাবে মজুরি বাড়িয়ে অচিরেই নাকি হচ্ছে মোটা অঙ্ক—মাসে আট হাজার টাকা। আট হাজার টাকায় মাস চালাতে হবে কয়েক সদস্যের একটি পরিবারকে। ধরে নিলাম মাত্র তিনজনের ছোট পরিবার। এই আট হাজার টাকায় খাট রাখার জায়গার ভাড়া, সারা মাসের খাবার, এক বা দুই জোড়া সালোয়ার-কামিজ, লুঙ্গি-গেঞ্জি, বাচ্চার জামা, কিছু ওষুধ এবং নুন-মরিচ। এর বেশি কি কিছু সম্ভব? হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর আর কিছু ওভারটাইম আর তাতে হয়তো এক জোড়া স্যান্ডেল এবং বাবার একটি লুঙ্গি মিলবে—এই তো জীবন।

১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘অতি ধনীর সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে কেন?’ শিরোনামে আলী রীয়াজের একটি লেখা ছাপা হয়। তিনি এই অতি ধনীদের টাকাপয়সার বিভিন্ন হিসাব তুলে ধরেছেন। এই টাকার একটা অংশ উড়ে উড়ে কানাডা, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ কত দেশে যে যাচ্ছে, তারও একটা ধারণা দিয়েছেন। আমি আরেকটি যোগ করি, ঢাকা থেকে লন্ডন যেতে এয়ারলাইনস–ভেদে ইকোনমি ক্লাসের ভাড়া ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া কমবেশি ৩ লাখ টাকা। বাঙাল বড় লোকেরা আজকাল শুধু নিজেরাই ফার্স্ট ক্লাসে যায় না, ফার্স্ট ক্লাসে নিয়ে যায় এক বা একাধিক ‘আয়া’কেও, জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে।

আমরা ভীষণভাবে ধনী হচ্ছি অর্থাৎ নির্বিচার, অমানুষিক ও ভীষণ লুটপাট এখন হয়ে গেছে গুটিকয়েক মানুষের একচ্ছত্র অধিকার। আর আমরা যাতে টুঁ শব্দ না করি, সেই জন্য শিক্ষার্থী আর শহিদুল আলমেরা যাচ্ছেন জেলে। লাখ লাখ শ্রমিককে আট হাজার টাকা মাসিক বেতন দিয়ে রেখে নির্দিষ্ট ও সীমিত কিছু মানুষের কোটি কোটি টাকার পাহাড়-পর্বত রাতারাতি গড়ে তোলার যেই ব্যবস্থাপত্র বহাল আছে, সেটাই এখনকার রাজনীতি, এখনকার অর্থনীতি।

২.

যেখানে অতি ধনীদের সংখ্যা সর্বোচ্চ গতিতে বাড়ে, অর্থাৎ আমরা ফার্স্ট হই; সেখানে এটা অবধারিত যে অন্যান্য সূচকে আমরা একেবারে লাস্ট না হলেও লাস্টদের কাতারে থাকব। নজর দেওয়া যাক সপ্তাহ দুয়েক আগে শেষ হওয়া এশিয়ান গেমসে পদক তালিকার দিকে। এশিয়ান গেমস অর্থাৎ খেলাধুলায় পরাশক্তি, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলো, আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের দৌড়বিদ—কেউই ছিল না। আমাদের মতো এশিয়ার প্রায় গোটা পঞ্চাশেক দেশ এই খেলাধুলায় প্রতিযোগিতা করেছে। সবচেয়ে বেশি পদক পেয়েছে চীন, সব মিলিয়ে ২৮৩টি। এরপর জাপান, মোট ২০০টি। তালিকার শেষের দিকে আছে আফগানিস্তান আর মিয়ানমার। পদক পেয়েছে ২টি করে। একটি হলেও পেয়েছে নেপাল ও সিরিয়া। একটিও পায়নি ৮টি দেশ। শূন্য পদক পাওয়া ৮টি দেশের মধ্যে আমাদের গর্বিত স্থান। ১৬ কোটি লোকের দেশ, কিন্তু পদক পেলাম না একটিও। তা–ও আবার এশিয়ান গেমসে অর্থাৎ তৃতীয় বিভাগের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি ধারণা সূচকের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি। বড় দাগের উপসংহার হলো, যে দেশ যত বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত, সেই দেশের প্রাপ্ত পদক বা মেডেলের সংখ্যা তত কম। যেমন আফগানিস্তানের স্থান ১৭৭তম, সিরিয়া আছে ১৭৮, অবশ্য টিআই সূচকে নেপালের অবস্থান তত খারাপ না, ১২২তম। দু-একটা ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। উজবেকিস্তান মেডেল পেয়েছে মোট ৭০টি, মেডেল তালিকায় স্থান পঞ্চম। তবে দুর্নীতির ধারণা সূচকে উজবেকিস্তানের স্থান ১৫৭তম। মোটামুটি আমাদের কাছাকাছি। দুর্নীতিতে আমাদের থেকে খুব বেশি পিছিয়ে নেই। এ রকম দু-চারটা ব্যতিক্রম সমাজবিজ্ঞানের যেকোনো বিশ্লেষণে থাকতেই পারে, কিন্তু তাতে মূল কথাটা পণ্ড হয়ে যায় না। গণতন্ত্র না থাকলে বা ছিটেফোঁটা থাকলে দুর্নীতি থাকবে সমুদ্রের মতো বিশাল। দেশ পিছিয়ে থাকবে প্রায় সব সূচকেই, খেলাধুলায়, মেডেল তালিকাতেও। আর সীমিত গণতন্ত্রে দুর্নীতির দেশ অবলীলায় হয়ে যাবে ধনী আর অতি ধনীদের লীলাভূমি।

৩.

নির্বাচন আসছে। এক জোট, দুই জোট, তিন জোট—কে কার সঙ্গে জোট বাঁধছে-ভাঙছে, কে মনোনয়ন পাচ্ছে বা মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে—এসব নিয়েই আজকাল পত্রপত্রিকায় সয়লাব। নির্বাচন কীভাবে হবে, খালেদা জিয়ার কী হবে, ইভিএম, গায়েবিসহ হরেক রকমের মামলা—এসবই এখন মুখ্য। কিন্তু আমরা কাকে, কেন ভোট দেব; সে ব্যাপারে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই নিশ্চুপ। ব্যতিক্রম আওয়ামী লীগ। তারা বলছে, এককথায় উন্নয়নের বর্তমান ধারা বজায় রাখতে হলে নৌকায় ভোট দিতে হবে। উন্নয়নের জোয়ারই তাদের মূল কথা। এই জোয়ারে ভোটের নৌকা ভাসবে না ডুববে, সেটা নির্ধারণ করবেন ভোটাররা। অবশ্য চান্স পেলে। সুষ্ঠু ভোটাভুটি না হলে চান্স তো আর আসবে না। অন্য দলগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়েই ব্যস্ত। নির্বাচিত হলে কী করবে, এ ব্যাপারে নববধূর মতোই প্রায় নিশ্চুপ। মুখ খোলেনি।

অতি ধনীদের ব্যাপারে কী করবে। শুধু কি তাদেরই নমিনেশন দেবে। কোন দল থেকে কতজন কোটিপতি এবার নমিনেশন পাচ্ছেন, সেটা অবশ্যই আমরা দেখব এবং দেখে পুলকিত হব। দুর্নীতি দমনের কথা সবাই বলবেন। গত বিএনপি আমলে মূলত বিদেশিদের চাপে পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৪ সালে। ২০০৭-এর ১/১১ পর্যন্ত বিএনপি আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কাজ ছিল কার কী ক্ষমতা, সেই নিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ। দুর্নীতি দমনের আসল কাজ কিছুই হয়নি বললেই চলে। তাই এখন যদি তাঁরা বলেন, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ করব, তাহলে ভোটাররা ভীষণ আস্থা পাবে বলে ধারণা করা কঠিন। আর বর্তমান আমলে দুদক মহাব্যস্ত বিরোধী রাজনীতিবিদ আর চুনোপুঁটির পেছনে। রাঘববোয়ালদের কিছুই হয় না। এমনকি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের বেঞ্চ দুদকের কর্মকর্তাদের আদালতে ডেকে পাঠিয়েও রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে কমিশনকে দিয়ে বলতে গেলে কিছুই করাতে এখনো পর্যন্ত পারেননি।

৪.

রাষ্ট্র যখন স্বল্প কিছু লোককে সুযোগ-সুবিধা দিতে অর্থাৎ অতি ধনী বানাতে সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট হয়, তখন তাকে আরও বেশ কয়েকটি কাজ করতে হয়। প্রথমেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্তত একটা অংশকে যা ইচ্ছে তাই করার লাইসেন্স দিতে হয়। যারা চেঁচামেচি বা প্রতিবাদ করে বা বাধার সৃষ্টি করে, তাদের ছলেবলে কৌশলে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। এই তালিকার প্রথমেই থাকে আদালত ও সংবাদমাধ্যম। তারপর মনোবল ভেঙে দিতে হয় ছাত্রছাত্রীদের—সাধারণত জেল–জুলুম, মারপিট, ভয়-ব্ল্যাকমেল ইত্যাদি পরীক্ষিত ব্যবস্থায়। এরপরে আসে ব্যবসায়িক আর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এই প্রক্রিয়ার অন্য প্রান্তে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ একচ্ছত্র অধিকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় এক ব্যক্তি। রবার্ট মুগাবের মতো দীর্ঘস্থায়ী নেতা তখন হয়ে পড়ে স্বাভাবিক। অতি ধনীদের আর দুর্নীতিবাজদের দেশের এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য।

ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক