ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে কূটনৈতিক ঝুঁকি

প্লাবন ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করার বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। ছবি: রয়টার্স
প্লাবন ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করার বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। ছবি: রয়টার্স

কক্সবাজারের জনসমাজে কান পাতলেই এ মুহূর্তে উৎকণ্ঠার আভাস পাওয়া যায়। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় এই উৎকণ্ঠা কিছুটা উদ্বেগের রূপ নিচ্ছে।

ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ শিগগির শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ‘ভাসানচর’ নামের দ্বীপে স্থানান্তর শুরু করবে। প্রাথমিকভাবে স্থানান্তরের লক্ষ্য প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা।

এরই মধ্যে ভাসানচরের প্রায় দেড় হাজার একর জমিতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে অনেক অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে। সরকারের পক্ষে নৌবাহিনী এই দায়িত্ব পালন করেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, শীতের শুরুতে এবং নির্বাচনের আগেই সরকার রোহিঙ্গা স্থানান্তর-প্রক্রিয়া শুরু করতে ইচ্ছুক। কিন্তু এ নিয়েই রোহিঙ্গা শিবিরে এবং কক্সবাজারের ভেতরে-বাইরে শরণার্থী দেখভালে যুক্ত আন্তর্জাতিক মহলে রয়েছে দুশ্চিন্তা।

স্থানান্তর স্বেচ্ছামূলক হবে তো?
ভাসানচর নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার অধীন একটা এলাকা। তবে হাতিয়া থেকে ১৮-১৯ কিলোমিটার দূরে এই চরের অবস্থান। নোয়াখালীর মূল ভূমি থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। উত্তাল জলরাশির মাঝে দুর্গম ভূমিই বলা যায় একে।

উপকূলীয় জেলেরা একে ‘ঠেঙ্গারচর’ নামেও ডাকেন। যা মূলত সন্দ্বীপের ন্যায়ামস্তি ইউনিয়নের ভাঙন-পরবর্তী জেগে ওঠা জমি বলে স্থানীয়দের মত। ২০০৬ সালে সাগরের ভেতরে এই চর জেগে ওঠে। চরের মালিকানা নিয়ে হাতিয়া-সন্দ্বীপে প্রশাসনিক মতদ্বৈধতাও আছে। বিবাদিত সেই দ্বীপেই প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের একাংশকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে শতাধিক গুচ্ছগ্রামে দেড় হাজার ঘর তোলা হয়েছে।

প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প নেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকেও অবহিত করেছিল। কয়েক ডজন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর শত শত শ্রমিককে ব্যবহার করে উদ্যোগটির অনেকখানি প্রায় শেষ। নৌবাহিনী দক্ষতার সঙ্গেই দ্রুত তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর-প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের যুক্তিগুলো স্পষ্ট। সরকারের বিবেচনায় রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রায় ১০ লাখ মানুষকে কক্সবাজারের স্বল্প পরিসরের ক্যাম্পগুলোয় আটকে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ। ভাসানচরে তাঁবুর পরিবর্তে আরও ভালো অবকাঠামোতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। সেখানে খোলামেলা থাকার জায়গার পাশেই থাকবে রান্নাঘর, গোসলখানাসহ প্রয়োজনীয় অনেক সুবিধা।

এই স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের ভিন্ন কিছু বিবেচনাও কাজ করে থাকতে পারে। রোহিঙ্গারা যাতে ক্রমে বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীতে মিশে যেতে না পারে এবং তাদের ঘিরে যেন কোনো রকম সশস্ত্র তৎপরতা গড়ে না ওঠে, তার নজরদারির জন্য কক্সবাজারের বর্তমান স্থান থেকে এদের সরানো জরুরি মনে করা হয়েছে। বাংলাদেশের ওপর এ ক্ষেত্রে বন্ধুপ্রতিম কিছু দেশেরও প্রভাব কাজ করে থাকতে পারে।

সমস্যা হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকটে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মহল সংশ্লিষ্ট। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের এই পালিয়ে আসা নাগরিকদের দেখাশোনায় যুক্ত। কোটি কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে এবং দিচ্ছে তারা। আন্তর্জাতিক পরিসরেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের লড়াইয়ে এরা বন্ধু। এসব সংস্থা মনে করছে, শরণার্থীদের মাঝে যেহেতু বিপুল নারী ও শিশু রয়েছে, সে কারণে প্রস্তাবিত স্থানান্তর-প্রক্রিয়া অবশ্যই স্বেচ্ছামূলক হতে হবে। জোর করে শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে নোয়াখালী নেওয়ার অবকাশ নেই। জনমানবহীন ভাসানচরে পুনর্বাসন রোহিঙ্গাদের জীবনযাপনে বিরূপতা তৈরি করবে কি না, সেটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার জগতে এ মুহূর্তে বড় এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

পুনর্বাসনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ
বলা হচ্ছে, মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশ এককভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রথমত, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নাগরিক নয়। এখানে আশ্রয় নিয়েছে মাত্র। বাংলাদেশের আগ্রহ ও অনুমোদনেই রোহিঙ্গাদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যুক্ত হয়েছে। ফলে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়াই সংগত হবে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ভাসানচরে বন্যার ঝুঁকি প্রবল। দ্বীপটি জেগে উঠেছে বেশি দিন হয়নি। এর ভূমি কাঠামো মানববসতির জন্য কতটা উপযোগী তা প্রশ্নসাপেক্ষ। যেখানে হঠাৎ করে বিপুল মানুষের পুনর্বাসনে কক্সবাজারের বর্তমান অবস্থার চেয়ে অধিক ঝুঁকি তৈরি করে কি না, সে সন্দেহ রয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার অবশ্য বলছে, জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি কমাতে তারা দ্বীপের চারদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু করে বাঁধ দিচ্ছে এবং শতাধিক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রও গড়া হয়েছে। দ্বীপটির চারদিকে প্রতিবছর নতুন ভূমিও গড়ে উঠছে, যা এর স্থায়িত্ব ও সুরক্ষার জন্য ইতিবাচক।

তবে বঙ্গোপসাগরের চরগুলো গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় বিলীন হওয়ার নজিরও আছে। ভাসানচরের পশ্চিমে ‘ইসলামের চর’ নামে একটি চর জেগে ওঠার তিন দশক পর এখন ক্রমে বিলীন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলেরা। ভাসানচরের ক্ষেত্রে ওই রকম ঘটলে পুনর্বাসিত রোহিঙ্গাদের নতুন করে কোথাও নেওয়া বিরাট ব্যয়সাপেক্ষ বিষয় হবে।

শরণার্থী স্থানান্তরে যে কারণে ঝুঁকি
ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রস্তাবিত স্থানান্তর-প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের চেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ শরণার্থী প্রত্যাবর্তনে মাত্র কিছুদিন আগেই মিয়ানমারের সঙ্গে এক দফা সমঝোতায় পৌঁছেছিল এবং জাতিসংঘের দুটি সংস্থার (ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধিরা এরূপ প্রত্যাবর্তনের শর্ত দেখতে আরাকানে রয়েছেন এখন। শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে পাঠানো এ ক্ষেত্রে স্ববিরোধী পরিস্থিতি তৈরি করে কি না, সেটা ভাবা দরকার। বর্তমানের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ‘উন্নত’ এবং স্থায়ী পরিসরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা মাত্রই মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের গ্রহণ এবং পুনর্বাসনে নিশ্চিতভাবে নিরুৎসাহ দেখাবে। বাংলাদেশের পুনর্বাসন উদ্যোগ মিয়ানমারের ওই প্রচারণাকেও শক্তি জোগাবে, ‘রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেরই নাগরিক’।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় ঝুঁকির দিক হলো আন্তর্জাতিক মহলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে এই স্থানান্তর-প্রক্রিয়া শুরু হলে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনীতিক পরিসরে একা হয়ে যাবে। সেটাও পরোক্ষে মিয়ানমারের হাতকে শক্তি জোগাবে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বর্তমানে রোহিঙ্গাদের খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে,Ñভৌগোলিক কারণেই ভাসানচরে সেটা সম্ভব নাও হতে পারে। স্থানটি সাগরের প্রবল জোয়ার-ভাটার আওতাভুক্ত। হাতিয়া থেকে নৌযানে ভাসানচরে যাওয়া সম্ভব প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টায়। সংগত কারণেই সেখানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্যকর্মীদের জন্য যাতায়াত সহজ হবে না। প্রাকৃতিক ঝুঁকির কারণেই এরূপ যাতায়াত দ্রুত কমে যাবে। স্থানান্তর-প্রক্রিয়া নিয়ে মতদ্বৈধতা হলে এরূপ সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম থেকে ক্রমে সরে আসারও ঝুঁকি রয়েছে। সে রকম অবস্থায় ভাসানচরে পুনর্বাসিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ প্রশাসনের জন্য স্থায়ী বোঝায় পরিণত হতে পারে।

চতুর্থত, স্থানান্তর নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ অগ্রাহ্য হলে ভবিষ্যতে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জীবনযাপনের যেকোনো বিপর্যয়ের দায়ভার পুরোপুরি বাংলাদেশ সরকারের ওপরই বর্তাবে। ওই এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও দুর্ঘটনাপ্রবণ অঞ্চল। জোয়ারের সময় ভাসানচরের বিপুল এলাকা পানিতে ডুবে যায়। এসব জেনেও রোহিঙ্গাদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে যে অভিনন্দন ও সহানুভূতি পাচ্ছে, তার উল্টো ঘটনা ঘটতে পারে তাতে।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মহলের সংশ্লিষ্টতা যদি কমে যায়, তাহলে ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারির দায়িত্ব কেবল বাংলাদেশের ওপরই বর্তাবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দস্যুতার যে প্রকোপ, তা থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষার দায়ও বাংলাদেশকেই বইতে হবে। সে জন্য ভাসানচরে বর্তমানে যে নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে, সেটা ক্রমে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যয়েও চাপ বাড়াবে স্থায়ীভাবে। এ ছাড়া ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের যদি পাশের জলরাশিতে মাছ ধরার অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তাদের ওপর নজরদারিও দুরূহ হবে। সে ক্ষেত্রে মানব পাচার আরও বেড়ে যেতে পারে এবং তার কারণে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ দোষারোপের শিকার হতে পারে।

ষষ্ঠত, এরূপ স্থানান্তর নিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের মতদ্বৈধতা তৈরি হলে তা বড় ধরনের নিরাপত্তা-উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। গত এক বছর বাংলাদেশ যে নির্বিঘ্নেœকক্সবাজার অঞ্চলে শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় অভিনন্দনযোগ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পেরেছে, তার বড় কারণ রোহিঙ্গাদের আন্তরিক সহায়তা। এক মিলিয়ন মানুষকে দেশের যেকোনো স্থানে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকার ও শরণার্থীদের মাঝে বিদ্যমান ইতিবাচক মনোভাবটি যেকোনো মূল্যে ধরে রাখা ভবিষ্যতের জন্যও জরুরি। বিশেষ করে মিয়ানমারের ক্রমাগত দায়িত্বজ্ঞানবর্জিত আচরণের কারণে রোহিঙ্গাদের মাঝে যখন প্রতিবাদী কিছু করার চরম আবেগ রয়েছে, তখন বাংলাদেশের উচিত নয় তাতে বাড়তি উত্তেজনার রসদ জোগানো।

উদ্বেগজনক এরূপ নানান শঙ্কা ছাড়াও দুর্ভাবনার বড় বিষয় হয়ে উঠেছে স্থানান্তর-প্রক্রিয়ার সময় নিয়ে। শিগগির বাংলাদেশে নির্বাচনী আয়োজন শুরু হবে বলেই মনে হয়। এ সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকবে উত্তাল। রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকবে নির্বাচনকালীন সরকার। সেই সরকারের রূপ নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র বিতর্ক ও অনিশ্চয়তা আছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা স্থানান্তর নিয়ে তাদের তরফ থেকে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে যদি প্রবল ভিন্নমত তৈরি হয়, তার মোকাবিলায় বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ, যা এই ইস্যুতে ঢাকার পক্ষে আরও জটিল অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক