নিম্ন মজুরি এবং মালিকপক্ষের চার যুক্তি

শ্রমিকদের মজুরি যুক্তি দিয়ে নির্ধারণ হয় না, হয় আপেক্ষিক শক্তি দিয়ে
শ্রমিকদের মজুরি যুক্তি দিয়ে নির্ধারণ হয় না, হয় আপেক্ষিক শক্তি দিয়ে

আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হলো। সরকার পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করেছে মাত্র ৮ হাজার টাকা, যা বিভিন্ন শ্রমিকসংগঠনের দাবির ৫০ শতাংশ, মূল মজুরি বাড়ানো হয়েছে ১ হাজার ১০০ টাকা। আর এই বৃদ্ধির অজুহাতে আবার মালিকদের নানাবিধ সুবিধা আরও বাড়ানো হয়েছে। আগের অনেক কম মজুরির পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষিত মজুরি বৃদ্ধি হিসেবেই হাজির করা হচ্ছে। কিন্তু নিম্ন মজুরি-নিম্ন উৎপাদনশীলতার ফাঁদ থেকে বাংলাদেশের শিল্প খাতকে মুক্ত করার জন্য দরকার ছিল একটি নতুন যাত্রা, অন্তত দারিদ্র্যসীমার আয়ের ওপরে নিম্নতম মজুরি শুরু করা। এটা মজুরি বৃদ্ধি নয়, মজুরি যৌক্তিকীকরণের প্রশ্ন।

এর আগে ১০ সেপ্টেম্বর বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর এক যৌথ জরুরি সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘তৈরি পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি যতটুকু বাড়বে, সরকারের কাছ থেকে তার সমপরিমাণ সুবিধা’ চান পোশাক কারখানার মালিকেরা। সে জন্য তাঁরা সরকারের কাছে নতুন করে কর হ্রাস কিংবা নগদ সহায়তার দাবি তোলেন। দাবি তুলে অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁদের। যেদিন এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, সেদিনই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংক দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। এই দুটো প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নগদ সহায়তা বৃদ্ধি ছাড়াও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের উৎসে কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, করপোরেট করও কমানো হয়েছে। বাজেট পাসের পর তিন মাস পার হওয়ার আগেই শৃঙ্খলা ভেঙে এই পরিবর্তন আনা হলো।

যাহোক, বিজিএমইএ-বিকেএমইএর নেতারা মজুরি ‘বাড়ানো’ বা যৌক্তিকীকরণের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেন, তার মধ্যে চারটি যুক্তি প্রধান। এগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার।

প্রথমত, একটি যুক্তি হলো, ‘বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের দাম কমে যাচ্ছে। বেশি বেশি প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে। সে জন্য মজুরি বাড়ানো যাবে না।’

উৎপাদন-প্রক্রিয়ার আর সব পণ্যের মধ্যে শ্রমিকের শ্রমশক্তি একটি। আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের দাম কমলে কিংবা প্রতিযোগিতায় মালিকপক্ষের ব্যর্থতার কারণে কি অন্য কোনো পণ্যের দাম কমানো যায়? দাম কম দিয়ে পার পাওয়া যায়? এত শক্তিশালী সংগঠন মালিকদের, তারা কেন এ বিষয়ে ভূমিকা পালন করতে পারে না? কেন এই সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে দামের পতন রোধ করতে পারে না? কেন ব্র্যান্ড ও বায়ারের প্রভাবের সামনে ‘নির্দিষ্ট দামের নিচে পোশাকের দাম নামানো যাবে না’ মর্মে শক্ত ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয় না? অর্ডার পাওয়ার কাড়াকাড়িতে অনেকেই যৌক্তিক দামের নিচে পোশাক সরবরাহ করতে রাজি হন আর নিজের মুনাফা উশুল করতে দুর্বল শ্রমিকের ঘাড়ে তা চাপান। মালিকদের লোভ আর ব্যর্থতার দায় কেন শ্রমিকেরা নেবেন?

দ্বিতীয়ত, আরেকটি যুক্তি প্রায়ই শোনা যায়, ‘বাংলাদেশের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম। সে জন্য মজুরিও কম।’ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধির হার এবং রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এই যুক্তি কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের নিম্ন উৎপাদনশীলতার পরিপ্রেক্ষিতেও ‘বর্ধিত’ নিম্নতম মজুরি অনেক কম। এটা অবশ্যই ঠিক যে শ্রমিকদের বা শ্রমের উৎপাদনশীলতা আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে এবং তা বাড়ানো দরকার। কিন্তু এটাও পরিষ্কার থাকা জরুরি যে শ্রমের উৎপাদনশীলতা আসলে নির্ভর করে মালিকদের ভূমিকার ওপর; নির্ভর করে প্রযুক্তি, কর্মপরিবেশ, ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষণ, মজুরি, পুষ্টি, অবসরের ওপর। এগুলো সবই মালিকদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে জন্য শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম থাকলে তার দায়িত্ব প্রধানত মালিকদেরই, শ্রমিকের নয়। সুতরাং আবারও প্রশ্ন, মালিকদের ব্যর্থতার দায় শ্রমিকেরা কেন নেবেন?

তৃতীয়ত, একটি যুক্তি প্রায়ই শোনা যায়, ‘পোশাকশিল্পের সামর্থ্য নেই। মজুরি বাড়ালে শিল্পে ধস নামবে।’ এই যুক্তিও তথ্যসমর্থিত নয়। বাংলাদেশে এই শিল্পের সক্ষমতা যে বাড়ছে, তা এর প্রবৃদ্ধি, বিশ্ববাজারে তার অবস্থান থেকেই বোঝা যায়। প্রতিবছরই যখন মজুরি বাড়ানো বা যৌক্তিকীকরণের কথা আসে, তখনই মালিকপক্ষ থেকে এই যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। আন্দোলন ও জনমতের চাপে বিভিন্ন সময়ে (২০০৬, ২০১০, ২০১৩) যতটুকু মজুরি সমন্বয় করা হয়, তাতে এই শিল্পের ধস নামতে দেখা যায়নি; বরং আরও বিকাশই দেখা গেছে। ১৯৯৪ সালের তুলনায় ২০১৮ সালের ঘোষিত নিম্নতম মজুরি পর্যন্ত বেড়েছে ৮ গুণ, আর পাশাপাশি একই সময়ে গার্মেন্টস রপ্তানি আয় বেড়েছে কমপক্ষে ১৪ গুণ (টাকায় হিসাব করলে রপ্তানি আয়ের বৃদ্ধির হার আরও বেশি হবে)। তাহলে?

চতুর্থত, যুক্তিতে বলা হয়, ‘শ্রমিকেরা তো দু-তিনজন মিলে ভালোই আয় করছেন।’ ভালো আয় বলতে বোঝানো হয় মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয়। এর পক্ষে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয় তা ভুল। যেমন একজন শ্রমিকের মাসিক আয় বলে যে তথ্য দেওয়া হয়, সেগুলোতে ওভারটাইম উল্লেখ করা হয় না। কোনো শ্রমিক ১০ থেকে ১২ বা ১৪ ঘণ্টা কাজ করে যে মজুরি পান, সেটা তাঁর স্বাভাবিক আয় নয়, ৮ ঘণ্টা কাজ করেই তাঁর বাঁচার মতো মজুরি পাওয়ার কথা। কোনো পরিবারে দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কাজ করে যে মজুরি পান, সেটা উল্লেখ করে এক ব্যক্তির পাওনা মজুরি যুক্তিযুক্ত করা যায় না। এক ব্যক্তির যা আয় করার কথা, তা যদি পরিবারের দু-তিনজনের আয় দিয়ে পূরণ করতে হয়, তাহলে তা খুবই অস্বাভাবিক এবং অযৌক্তিক পরিস্থিতি। সেটাই এখন চলছে বাংলাদেশে।

মজুরি বা নিরাপত্তা নিয়ে কারও কথা পছন্দ না হলেই মালিকপক্ষ থেকে খোঁচা দিয়ে বলা হয়, ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’। তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যাঁরা পোশাক কারখানা দেননি, তাঁরা কথা বলবেন কেন? মনে রাখা দরকার, শ্রমিকদের মজুরিসংক্রান্ত দাবি কোনো দয়াদাক্ষিণ্যের বিষয় নয়, মালিকেরাও শ্রমিকের মা-বাবা নন। শ্রমিকেরা তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে মজুরি পাচ্ছেন, মালিকেরা শ্রম খাটিয়ে মুনাফা করছেন। দুই পক্ষের চুক্তির সম্পর্ক। মজুরির নির্দিষ্ট নিয়ম মালিকেরা যাতে মানেন, সেটা দেখা সরকারের দায়িত্ব। সেখানে গাফিলতি হলে দেশের অন্য নাগরিকদের বলার দায়িত্ব ও এখতিয়ার আছে।

একটি পরিবারের টিকে থাকার সামগ্রী দিয়ে নিম্নতম মজুরির হিসাব করা হয়। তাই নিম্নতম মজুরি কোনো যুক্তিতেই দারিদ্র্যসীমার আয়ের নিচে হতে পারে না। ঢাকা শহরে সরকারের নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার আয়ের দ্রব্য ব্যয় হিসাব করলে একটি পরিবারের জন্য তা ১৮ হাজার টাকার বেশি হয়, ঢাকার বাইরে একটু কম। তার নিচে তাই যুক্তি অনুযায়ী মজুরি হতে পারে না। কিন্তু আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দেখি মজুরি যুক্তি দিয়ে নির্ধারণ হয় না, হয় আপেক্ষিক শক্তি দিয়ে। মজুরেরা অসংগঠিত থাকলে মজুরি কম, সংগঠিত হলেই তা একটু বাড়ে। আন্দোলন, মিছিল সমাবেশ, আক্রমণ হুমকি মোকাবিলা ছাড়া মজুরিতে এতটুকু পরিবর্তন আনা যায় না।

গার্মেন্টস ও নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে অগণিত সংগঠন-সমিতি আছে, ভেঙে একাকার হলেও এই সংগঠনগুলোর ঐক্য সংহতি অটুট। দলে দলে এত বিভাজন-সংঘাত, তা এখানে ঘটে না। বিভিন্ন দলমতের অনুসারী হলেও এসব সংগঠনের প্রভাব সরকারের ওপরও প্রবল, কখনো কখনো দুই শক্তি একাকার। শ্রেণি ঐক্য যে অন্য সব ঐক্যের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর, তা তাঁরা প্রমাণ করেছেন। সাড়ে ৩ হাজার মালিকের শক্তিশালী ঐক্যের বিপরীতে ৩৫ লাখ শ্রমিকের সংগঠিত ঐক্য একেবারেই নেই। যাতে তা গড়ে না উঠতে পারে, সে জন্য মালিকপক্ষ ও সরকার সদাসতর্ক। এই দুর্বলতারই প্রতিফলন—বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন, আর ধনিক শ্রেণির বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ।

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক