বিতর্কের সময় শেষ

২০১১ সালের জুনে সংশোধিত সংবিধানের আওতায় ভবিষ্যতে যে নির্বাচন হবে, তা হবে পৃথিবীর ইতিহাসে অভিনব পদ্ধতির নির্বাচন। অভিনব এ জন্য যে ওই সংশোধনীর আগে সংবিধানে বলা ছিল, জাতীয় সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু এবার সরকার চাইলে সংসদ রেখে নির্বাচন করতে পারবে। সংসদ থাকবে, সাংসদেরা বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তার মধ্যেই মহাসমারোহে উত্সবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে।

সংবিধান যখন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন সরকার নাগরিক সমাজের মতামতও গ্রহণ করে। আমার মতো সাধারণ লোককেও ডাকা হয়েছিল এবং আমি তাতে সম্মানিত বোধ করেছি। উদ্যোগটি ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। রাজনীতিবিদদের বিশেষ করে আইনপ্রণেতাদের বাইরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়ার মূল্য অসামান্য। সংবিধান রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য, চোর-ডাকাত–গুন্ডা-বদমাশ সবারই শেষ আশ্রয় সংবিধান, শুধু দেশের ভালো ভালো ক্ষমতাবান মানুষের জন্য নয়।

কোনো সরকারই চিরকাল থাকে না। সংবিধান মোতাবেক সরকার আসে–যায়। অসাংবিধানিক সরকারের কথা আলাদা।

আলোচনার সময় আমি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে এক পৃষ্ঠার একটি লিখিত মতামত দিয়েছিলাম। তাতে আরও কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে রাষ্ট্রধর্মের বিধান তুলে দেওয়া এবং সংসদ রেখে নির্বাচনের বিধান যেন না হয়, সে ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলাম। আমরা একই দিকে থাকি বলে সংসদ ভবন থেকে গাড়িতে ফেরার পথে তাঁকে বলেছিলাম, সংসদ রেখে নির্বাচন করার বিধান দু–একটি নির্বাচনে সরকারি দলকে কিছুটা সুবিধা দিলেও দিতে পারে, কিন্তু ভবিষ্যতে খুব বড় ঝামেলার সৃষ্টি হবে। এমনকি সরকারি দলের জন্যই সমস্যা হতে পারে। সব সময় বর্তমান সংসদের সাংসদেরাই যে দলীয় মনোনয়ন পাবেন তার নিশ্চয়তা নেই। তিনি আমার কথায় মাথা নেড়েছিলেন।

সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার যুক্তি হিসেবে এখন বিরোধী দল থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে না দিলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সব প্রার্থী ও দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে না। সাংসদ যে প্রশাসনিক আনুকূল্য ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন, অন্য প্রার্থী তা পাবেন না। এই যুক্তি বিষয়টির একটি দিক, অন্য দিক নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। সংসদ রেখে নির্বাচন করলে সমস্যা যে শুধু বিরোধী দলের অ-সাংসদ প্রার্থীর তা নয়। এখন যাঁরা সাংসদ আছেন অথচ আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না, তাঁরা নিজের দলেরই অ-সাংসদ প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করবেন। তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তিন রকম প্রার্থীর মধ্যে: বর্তমান ভাগ্যবান এমপি, সরকারি দলের অ-এমপি প্রার্থী এবং বিরোধী দলের হতভাগ্য প্রার্থী।

বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করা যায়। ধরুন, একটি নির্বাচনী এলাকায় বর্তমানে আছেন সরকারি দলের সাংসদ জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবর নামে এক ব্যক্তি। তিনি অপব্যবসা ও দুর্নীতি করে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন, কিন্তু সেই অনুপাতে দলের তহবিলে বিশেষ দেননি। ফলে সরকারি দল এবার তাঁকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দিল শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নামের অন্য এক ব্যক্তিকে। সাংসদ মহা–আনন্দে ইলিয়াস শাহের পক্ষে কাজ করবেন এবং তাঁর স্ত্রী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁকে তা করতে দেবেন—বাঙালির ধমনিতে তেমন রক্ত প্রবাহিত নয়। নিজের দলের প্রার্থীকে হারানোর জন্য তাঁর পাঁচ বছরে অর্জিত অর্থের যদি অর্ধেকও ব্যয় করতে হয়, তাতে তিনি দ্বিধা করবেন না। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচার উপায় একটাই, বর্তমানে যাঁরা সাংসদ আছেন তাঁদের সবাইকে মনোনয়ন দেওয়া।

এই ব্যবস্থায় শুধু যে সরকারি দলের ভেতরে কোন্দল, হানাহানি বেড়ে যাবে  তা–ই নয়, প্রশাসনের সৎ ও নিরপেক্ষ অফিসারদেরও বিপদের শেষ নেই। যে এলাকার সাংসদ আওয়ামী লীগের নন, গৃহপালিত, সেখানে পরিস্থিতি হবে অন্য রকম।

বাঙালির অভিনবত্বের অন্ত নেই। একমাত্র আমাদের প্রজাতন্ত্রেই রয়েছে বিশ্বের প্রথম পাতানো বিরোধী দল। পাতানো বিরোধী দলের মাননীয় সাংসদ এবারও মনোনয়ন পেলেন। একই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী কুতুবউদ্দিন আইবেক এবং বিএনপির প্রার্থী ইকতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি। সেখানে ডিসি–এসপির বিপন্নতার শেষ নেই। সাংসদের সার্কিট হাউস ও পুলিশ প্রটেকশন প্রাপ্য। ওদিকে আইবেক সাহেব কোনো অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সার্কিট হাউসের সবগুলো কক্ষ দখল করে ফেলবেন। তাঁর কর্মীদের মোটরসাইকেলে সার্কিট হাউসের চত্বর ভরে যাবে। বাগানের ফুলগাছগুলো সব শেষ। দখলীকৃত সার্কিট হাউসের কক্ষগুলো থেকে তাঁকে সরানো কোনো এনডিসির পক্ষে অসম্ভব। ওদিকে বিএনপির বখতিয়ার খিলজির দিকে যদি ঘোর আওয়ামী লীগপন্থী ডিসিও তাকান এবং সার্কিট হাউসে তাঁর রাতযাপনের ব্যবস্থা করেন, রাত পোহানোর আগেই রটে যাবে তাঁর বাবা ছিলেন রাজাকার। অথচ তাঁর বাবা একজন ‘বীর প্রতীক’ এবং তাঁর পরিবারে রয়েছে দুজন শহীদ।

নষ্ট রাজনীতির কারণে যদি হাজার বছরের বাঙালি সমাজের রীতি-নীতি–শিষ্টাচার নষ্ট হয়ে যায়, সামাজিক ভারসাম্য ভেঙে পড়ে, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ রকম ক্ষতিকর। দু–একটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের কারণে একটি সরকারের অনেক ভালো কাজ আড়ালে পড়ে যায়। পত্রিকায় নিবন্ধ লেখকের চেয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা শতগুণ বেশি বোঝেন এবং তাঁরা প্রাজ্ঞ। তাঁদের পরামর্শ দেওয়া ধৃষ্টতা। দার্শনিকেরা অকাজের মানুষ, তাঁরা বহু দূরে দেখতে পান। রাজনীতিবিদেরা বাস্তব অবস্থা বিচার–বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেন। দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা রাজনীতিবিদেরা—সরকারি দলের এবং বিরোধী দলের—দেশের বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। তর্ক-বিতর্কের সময় শেষ। হাতে মাত্র কয়েকটি সপ্তাহ রয়েছে।

বিরোধী দলের যেকোনো দাবি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়, তা যদি অগ্রহণযোগ্যও হয়ে থাকে। তাতে বিরোধী নেতারা কী ভাবলেন, তার চেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষ কী মনে করে। একেক সময় একেক ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আশির দশকে ছিল এক রকম, নব্বইয়ের দশকে অন্য রকম। ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদ বিরোধী দল ও সাধারণ মানুষের দাবি মেনে নিয়ে ভুল করেননি। ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া বিরোধী দলের দাবির কাছে বশ্যতা স্বীকার করে সঠিক কাজটিই করেছিলেন। তাঁর ওই ক্ষণজীবী সংসদ একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে গেছে। ২০০৬ সালে খালেদা জিয়া জনগণের দাবি উপেক্ষা করে নিজের ও দেশের ক্ষতি করেছেন।

পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ। কিল, ঘুষি ও চাপাতির মহড়া থাকলেও বড় রকমের সন্ত্রাসী তত্পরতা নেই। মানুষ শান্তিই চায়। শান্তিপূর্ণ সমাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। রাজনৈতিক কারণে হিংসা-প্রতিহিংসামূলক তত্পরতায় পরিবেশ নষ্ট হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি স্বাভাবিক থাকলে পরিবেশ ভালো থাকে।

আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিটি দলেই যোগ্য প্রার্থী আছেন। কোথাও একই দলে একাধিক। এলাকার অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় ব্যক্তি যদি নির্বাচিত হতে না পারেন, তাতে মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ ও হিংসার জন্ম হয়। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তার বিকল্প হিংসা। শান্তির একটা সীমারেখা আছে, হিংসা-প্রতিহিংসার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। প্রতিহিংসা প্রকাশের উপায় বিচিত্র। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার পথ এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক সহজ ও বহুমুখী।

বিদেশি মোড়লেরা কে কী বললেন না বললেন, সেটা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না। তাঁরা রুটিন কথা বলেই যাবেন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, দেশের মানুষের স্বার্থে, আগামী নির্বাচন পূর্ববর্তী কয়েকটি নির্বাচনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে নেতারা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন, সেটা হবে দেশের মানুষের জন্য চরম দুর্ভাগ্যের।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক