পায়রার প্রতি স্নেহ ও বড় ভাইয়ের বঞ্চনা

চট্টগ্রাম বন্দর। ফাইল ছবি
চট্টগ্রাম বন্দর। ফাইল ছবি

গত বছর অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যা ও সম্ভাবনা বিষয়ে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এক ব্যবসায়ী নেতা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, নবজাতক কন্যার (পায়রা বন্দর) প্রতি অতিরিক্ত স্নেহ দেখাতে গিয়ে তার বড় ভাইটির (চট্টগ্রাম বন্দর) প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারছে না সরকার। কথাটি উঠেছিল চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরে বে-টার্মিনাল নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার প্রসঙ্গে।

হচ্ছে-হবে করে প্রায় চার বছর পার হওয়ার পর অবশেষে বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। ১১ সেপ্টেম্বর ৬৭ একর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৩৫২ কোটি ৬২ লাখ টাকা জেলা প্রশাসককে হস্তান্তর করার মাধ্যমে বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগটি প্রস্তুতি পর্বে পা রাখল। শুরুতে তৈরি হবে একটি ইয়ার্ড। ইয়ার্ডটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন যে প্রায় পাঁচ হাজার ট্রাক চলাচল করে, সেগুলোকে শহরের ভেতরে ঢুকতে হবে না। ফলে বন্দরনগরে যানজট অনেকটাই কমবে।

বে-টার্মিনালে বন্দরের বর্তমান চ্যানেলের মতো জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, বাঁকা চ্যানেল বা ড্রাফটের (গভীরতা) সীমাবদ্ধতা নেই। বর্তমান চ্যানেলে মাত্র ১৯০ মিটার দীর্ঘ ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। কিন্তু বে-টার্মিনালে যেকোনো দৈর্ঘ্যের ও ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমান পোর্ট জেটিতে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১৬টি জাহাজ বার্থিং করা যায়, আর বে-টার্মিনালে করা যাবে প্রায় ৩০-৩৫টি।

চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বেড়ে যাওয়ায় কনটেইনার হ্যান্ডলিং বেড়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় বন্দরের সামর্থ্য বাড়েনি। ফলে জাহাজজট, সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি কারণে ব্যয় ও ভোগান্তি বাড়ছে বন্দর ব্যবহারকারীদের। পরোক্ষে এর চাপ নিতে হচ্ছে পণ্যের ক্রেতা ও ভোক্তাদেরও। এসব কারণে বে-টার্মিনাল নির্মাণের বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করে এটিকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের (ফাস্ট ট্র্যাক প্রজেক্ট) আওতাভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।

কিন্তু সরকার বে-টার্মিনালকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় না এনে পায়রা বন্দর নিয়ে এগিয়েছে। ‘নবজাতক কন্যা’র প্রতি অত্যধিক স্নেহ ও ‘বড় ভাইয়ের’ প্রতি অবহেলার কথাটি উঠেছে এ কারণেই। অথচ পায়রা বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ ও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশাল বিনিয়োগ কতটা ফলপ্রসূ হবে-এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক আছে। সমুদ্র অর্থনীতি (ব্লু ইকোনমি)-সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পায়রা বন্দরের সুষ্ঠু পরিচালন ও সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত খননকাজ (মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং) চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, সমুদ্রের সঙ্গে এই বন্দরের সংযোগ স্থাপনের জন্য যেখানে চ্যানেল খনন করা হচ্ছে, সেই স্থানটি মেঘনার মোহনা থেকে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি নিয়ে গভীর সামুদ্রিক খাঁড়িতে প্রবাহিত হওয়ার পথের মধ্যে পড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক সিরাজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশের নদীধারা দিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৮০ কোটি টন পলি ও বালু বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। এর প্রায় অর্ধেক প্রবাহিত হয় মেঘনা অববাহিকা দিয়ে। সমুদ্রবক্ষ থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত জাহাজের নির্বিঘ্ন আসা-যাওয়ার জন্য যে রামনাবাদ চ্যানেলটি তৈরি করা হচ্ছে, সেটিতে প্রতিবছর বর্ষায় বিপুল পরিমাণ পলি জমবে। চ্যানেলটি কার্যকর রাখতে হলে নিয়মিত খননের মাধ্যমে ওই পলি অপসারণ করতে হবে। এ জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় ও কার্যক্রম নিয়মিত চালিয়ে যেতে হবে, তাতে সমুদ্রবন্দর সুষ্ঠু ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনা ও সংরক্ষণ করা দুরূহ ব্যাপার (প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল ২০১৭)।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ অবশ্য সমীক্ষা প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞের মন্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয়। তাদের দাবি, মেঘনা অববাহিকার সব বালু ওই পথে প্রবাহিত হয় না। যেটুকু যায় তা ‘মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং’ করে অপসারণ করা কঠিন হবে না। এমনকি পায়রা বন্দরকে ঘিরে বিরাট কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হবে বলে এর জন্য অর্থসংস্থানেও কোনো সমস্যা হবে না বলে তারা মনে করে।

তবে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের নিকট-অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। চট্টগ্রাম বন্দরে পলি জমে তার ড্রাফট (গভীরতা) কমেছে। ড্রেজিংয়ের কয়েক লাখ ট্রাক মাটি ও বালু ফেলা হয়েছে কর্ণফুলীর পাড়েই। এতে কর্ণফুলীর প্রশস্ততা কমেছে। মালয়েশীয় ঠিকাদার কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে গেছেন। সুতরাং পায়রা বন্দরের নিয়মিত ‘বাধ্যতামূলক’ ড্রেজিং খুব সহজসাধ্য হবে মনে করার কোনো কারণ নেই।

পায়রা বন্দরকে একটি ‘রাজনৈতিক বন্দর’ বলে অভিহিত করতে চান অনেকে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণ করতেই সরকার এই ‘হাতি’ পোষার উদ্যোগ নিয়েছে বলে তাঁদের ধারণা। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়েই যেহেতু মতদ্বৈধতা আছে, এ নিয়ে এখনই মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তা ছাড়া, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আকার সামাল দিতে আরও বন্দর গড়ে তোলা যে দরকার, সে বিষয়ে সবাই একমত। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, বিদ্যমান বন্দরটিকে সচল ও গতিশীল রেখেই অন্য প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে হবে।

দেশের বহির্বাণিজ্যের শতকরা ৮৯ ভাগ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। আমদানি-রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। নৌমন্ত্রী এই বন্দরের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে সম্প্রতি বলেছেন, ১০ বছরে বন্দরের তহবিলে টাকার পরিমাণ সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বিশ্বের ব্যস্ত ১০০ বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৭০ তম। সক্ষমতা বাড়াতে পারলে অবস্থানের দিক থেকে এতটা পিছিয়ে থাকত না এই বন্দর। যেমন বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল হয়েছিল ২০০৭ সালে। এই টার্মিনাল পুরোপুরি চালু করতে জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর জন্য ১০টি গ্যান্ট্রি ক্রেনের চাহিদা ছিল। কিন্তু প্রায় ১১ বছর পর এখানে আনা হয়েছে তিনটি গ্যান্ট্রি ক্রেন, যেগুলো এখনো চালু হয়নি। এ রকম দীর্ঘসূত্রতার কারণে সক্ষমতা হারাচ্ছে বন্দর।

এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরে বে-টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ সারা দেশের ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাসময়ে টার্মিনালটি চালু হলে বৈদেশিক বাণিজ্য গতিশীল হবে। দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব যে পড়বে, সন্দেহ নেই তাতে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক
[email protected]