এনআরসি-জুজু, ভয় পাও, ভয়

শুধু আসাম নয়, দেশের অন্য রাজ্যগুলোতেও এনআরসি তৈরির দাবি বিজেপির
শুধু আসাম নয়, দেশের অন্য রাজ্যগুলোতেও এনআরসি তৈরির দাবি বিজেপির

রাজস্থানের এক মন্দিরে দাঁড়িয়ে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ এই সেদিন বললেন, ‘উত্তর প্রদেশে এক লাখ-কাণ্ডের পরেও বিজেপি ভোটে জিতেছে। দেশের বিদ্বজ্জনেরা প্রতিবাদী হয়ে সরকারের দেওয়া পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও বিজেপি নির্বাচনে জিতেছে। এবারেও আমরা ভোটে জিতব, বিরোধীরা যতই হইহল্লা করুক না কেন।’

অমিত শাহর এই বজ্রনির্ঘোষের আগে-পরে বিন্দুমাত্র ভনিতা ছিল না। রাজনীতিকেরা সচরাচর একধরনের মুখোশ পরে থাকেন নিজেদের আড়াল করতে। অমিত শাহর তেমন কোনো মুখোশের প্রয়োজন হয়নি। কোদালকে কোদাল বলার ধৃষ্টতা দেখিয়ে সরাসরিই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, গণতন্ত্রের শর্ত যা–ই হোক না কেন, তিনি ও তাঁর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সেসবের তোয়াক্কা করে না। তাঁরা চলবেন তাঁদের শর্ত অনুযায়ী। এভাবেই তাঁরা ২০১৪ সালে গোটা দেশে জিতেছেন। একে একে দখলে এনেছেন দেশের তিন-চতুর্থাংশ। এভাবেই চলবেন এবং ২০১৯-এর বৈতরণিও পার হবেন।

অমিত শাহর মন্তব্য, তাঁর আচরণ, বিরোধীদের প্রতি কটাক্ষ ও উপেক্ষার মধ্য দিয়ে অতিপরিচিত সেই হিন্দি প্রবাদটা মনে পড়ে গেল, ‘হাতি চলে বাজার, কুত্তে ভোঁকে হাজার’। লোকসভার শেষ নির্বাচন ও তার পরবর্তী উত্তর প্রদেশসহ অন্য রাজ্যগুলোর ভোটের আবহ কি স্মরণে আছে? থাকলে দেখবেন, সাম্প্রদায়িকতার আগুনে বিজেপি কীভাবে হাত সেঁকেছে। মজফফরনগরের দাঙ্গার কথা এত সহজে ভোলার নয়। উত্তর প্রদেশে এক লাখ-নিধন দিয়ে যে ধরনের গোরক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত, ক্রমে ক্রমে তা পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে হরিয়ানা থেকে রাজস্থান হয়ে বিহার এবং গুজরাট হয়ে ঝাড়খন্ডে। এক লাখ বা পেহলু খানদের আর্তনাদ ও রক্তে রাঙা হয়েছে বিজেপির বিজয়-ললাট। একের পর এক মসনদ দখলে এসেছে অমিত শাহদের। পাগড়িটা ভরে গেছে ঝলমলে সব পালকে।

পুরোনো ও পরিচিত সেই সুর ভাঁজতে-ভাঁজতে এবারও যে তাঁরা পথ চলবেন যাবতীয় ওজর-আপত্তি নস্যাৎ করে, রাজস্থানের মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন অমিত শাহ। লক্ষণীয়, এই অমৃত বাণীর দুদিন আগে দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে বিশেষভাবে যে বিষয়টির ওপর তিনি জোর দেন, তার অতি সংক্ষিপ্ত ডাক নাম ‘এনআরসি’। ২০১৯–এর মহারণে এই এনআরসিই (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস অব ইন্ডিয়া বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) হতে চলেছে বিজেপির ব্রহ্মাস্ত্র।

সন্দেহ নেই, অনুপ্রবেশের বিষয়টি আসামে বরাবরই যথেষ্ট স্পর্শকাতর। রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তো বটেই, সাধারণ অরাজনৈতিক মানুষের কাছেও অনুপ্রবেশ শব্দটি প্রভূত অর্থবহ। অনুপ্রবেশের ধারাবাহিকতার মতো এই রাজ্যে অনুপ্রবেশবিরোধী রাজনীতিরও এক ধারাবাহিকতা রয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতায় এসে সেই ধারাবাহিকতায় বিজেপি শুধু গতিই জুড়ে দেয়নি, তার পরিধি বিস্তৃত করতে এখন মরিয়া। জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে পৃথক বিবৃতি প্রচার করার পাশাপাশি অমিত শাহর নির্দেশ, শুধু আসাম নয়, দেশের অন্য রাজ্যগুলোতেও এনআরসি তৈরির দাবি জোরালো করে তুলতে হবে। দলটির নীলনকশা এমন, আসামের পর পশ্চিমবঙ্গসহ পূর্বাঞ্চলের সব সীমান্তবর্তী রাজ্য তো বটেই, সেই সঙ্গে দিল্লি, হরিয়ানা,বিহার, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও কর্ণাটকেও শুরু করতে হবে ‘প্রকৃত’ নাগরিক তালিকা তৈরির কাজ। এই রাজ্যগুলোতেও অনুপ্রবেশকারীরা আস্তানা গেড়েছে বলে বিজেপির বিশ্বাস। ধীরে হলেও এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জির দাবি এই সব রাজ্যের বিজেপির নেতারা ওঠাতে শুরু করেছেন।

এনআরসি তৈরির মধ্য দিয়ে অনুপ্রবেশের মোকাবিলা বিজেপি কিন্তু করছে বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে। তারা পরিষ্কার একটা বিভাজনরেখা টেনে দিয়েছে দল ও সরকারের মধ্যে। দল যে ধরনের কথাবার্তা বলছে, সরকার তার ধারেকাছে দিয়েও হাঁটছে না। বাংলাদেশি মানুষের কাছে অতিপরিচিত যিনি, দুই দেশের সুসম্পর্কের খাতিরে যিনি একাধিকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন, বিজেপির সেই সর্বভারতীয় সম্পাদক রাম মাধব দিনকয়েক আগে ‘থ্রি–ডি’ ফর্মুলার কথা জানিয়ে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছেন। বিদেশিদের ‘ডিটেক্ট’, ‘ডিলিট’ ও ‘ডিপোর্ট’ বলেই তিনি থেমে যাননি। কোথায় ‘ডিপোর্ট’ করতে হবে, সে বিষয়টিও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বলেন, ‘লোকে জিজ্ঞেস করে কী করে ফেরত পাঠাবে? পড়শি দেশ? বন্ধু দেশ? বন্ধু দেশ তো সবাই...।’ বিজেপি নেতারা কখনো প্রকাশ্যে, কখনো ঘুরিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বললেও কেন্দ্রে বিজেপির মন্ত্রীরা কিন্তু বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করছেন না। এমনকি, অনাগরিকদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টিও তাঁরা যথাসাধ্য ঊহ্য রাখার চেষ্টা করছেন।

এই কৌশলের কারণ একাধিক। প্রথম ও প্রধান কারণ, এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই ভারতের একমাত্র বন্ধু। প্রতিবেশীদের মধ্যে নেপাল ও মালদ্বীপ অনেকটাই চীনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় চীনের প্রভাবও ক্রমেই বাড়ছে। দোকলামপর্বের পর চীনকে নিয়ে ভুটানের ভাবনাচিন্তাতেও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। একমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক দিক থেকে সে দেশে চীনা প্রভাব অনস্বীকার্য হলেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বিক সম্পর্ক ক্রমেই দৃঢ় হয়েছে। পারস্পরিক ভরসা ও বিশ্বাসের পরিধি বেড়েছে। এ অবস্থায় ভারত চায় না নাগরিকপঞ্জিকে কেন্দ্র করে সুসম্পর্ক বিষিয়ে যাক। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জানিয়েছেন, আসামে যা হচ্ছে তা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের শাসক দলের নেতাদেরও ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, চূড়ান্তভাবে বিদেশি নির্ধারণের কাজ শেষ হতে এখনো অনেক সময় বাকি। অতএব নির্বাচনে তার কোনো প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই।

দ্বিতীয় কারণ, বাংলাদেশের সরকারি অভিমত ভারতের জানা। বাংলাদেশ মনে করে না আসাম বা অন্য রাজ্যে বাংলাদেশিরা চলে গেছেন ও যাচ্ছেন। ফলে আসামে চিহ্নিত ‘বিদেশিদের’ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো এককথায় অসম্ভব। এ নিয়ে জোরাজুরি করলে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনজীবনে ভারতের এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে চিন্তা ও উদ্বেগ শীতের কুয়াশার মতো লেপ্টে রয়েছে। শাসক দলসহ জোটের সদস্যরা যাঁরাই সম্প্রতি ভারত সফরে এসেছেন, প্রত্যেকেই এনআরসি নিয়ে ভারতীয় নেতাদের কাছে নিজেদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও সাংসদ সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী তো দুই ভারতীয় মন্ত্রীকে বলেই দেন, ‘১১ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে জেরবার হচ্ছি। এর ওপর আসামের ৪০ লাখকে নিতে হলে আমরা নির্ঘাত মারা পড়ব।’ তাঁর এই মন্তব্যে সামাজিক মাধ্যমগুলোয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বলা হয়, সাংসদ প্রকারান্তরে মেনেই নিচ্ছেন আসামের অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশি! এই মন্তব্যের মধ্যে নিহিত সত্য হলো, বাংলাদেশ এনআরসি নিয়ে সত্যিই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

অথচ বিজেপির এখন আর কিছুই করার নেই। এনআরসি গুটিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই, যেহেতু নির্দেশ খোদ সুপ্রিম কোর্টের। এনআরসি গুটাতে তারা চায়ও না। কারণ, আগামী দিনের ক্ষমতা দখলে এটাই তাদের হাতিয়ার। এনআরসির পরিধি বাড়ানো এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে ‘অত্যাচারিত’ অমুসলমান মানুষজনকে নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভোটের বাজারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেরুকরণের অনুঘটক বলে তারা বিশ্বাস করে। পাশাপাশি এ কথাও স্বীকার করে, এ দেশ থেকে বিদেশি ‘মুসলমানদের বিতাড়ন’ গাছ থেকে পাকা আম পাড়ার মতো সহজ কাজ নয়। তাহলে?

রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে পারমাণবিক বোমার মতো এনআরসিকেও বিজেপি ‘ডেটারেন্স’ বা ‘জুজু’ হিসেবে তুলে ধরতে চায়। প্রতিবেশীদের তারা এই বার্তা দিতে চায়, ভারত মোটেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘ধর্মশালা’ নয়। সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে চলে হয়তো আসা যায়, কিন্তু জীবন হয়ে উঠবে দুর্বিষহ। অতএব ভয় পাও। ভয়। এনআরসিকে ভয় করতে শেখো। কাঁটাতারের বেড়া টপকানোর আগে আরও শতবার ভেবে দেখো।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি