'মেড ইন আমেরিকা'

গত ৯ আগস্ট ইয়েমেনের সাদায় স্কুলবাসে সৌদি জোটের বিমান হামলায় আহত হয় এই শিশু। ছবি: এএফপি
গত ৯ আগস্ট ইয়েমেনের সাদায় স্কুলবাসে সৌদি জোটের বিমান হামলায় আহত হয় এই শিশু। ছবি: এএফপি

বিশ্বে মানবাধিকারের ‘সোল এজেন্ট’ হিসেবে নিজেকে সারাক্ষণ জাহির করে বেড়ায় কথিত মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আদতে তারাই মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনকারী। স্বার্থের জন্য দেশটি মানবাধিকারকে ‘কার্পেটের তলায়’ ঢুকিয়ে রাখতে একটুও দ্বিধা করে না।

মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কপটতা প্রায়ই প্রকাশ্যে আসে। সমালোচনার মুখে তারা সাময়িক ঢোঁক গেলে। তারপর তলেতলে সমানে চলে পুরোনো খেলা। ইয়েমেনে কয়েক বছর ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সেখানে যে নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের দায় মোটেই কম নয়। সেখানে ডলারের কাছে মানবাধিকার হেরে গেছে।

ইয়েমেনে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হওয়ার কথা আগেই জানিয়েছে জাতিসংঘ। অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও একই অভিযোগ করে আসছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের জন্য ইয়েমেনে যুদ্ধে লিপ্ত সব পক্ষকেই দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের নাম দায়ী পক্ষের তালিকার শীর্ষে। তবে আড়ালে আরেকটি পক্ষ আছে। তারা দূরে বসে যুদ্ধের রসদ জুগিয়ে পকেট ভারী করছে। ইয়েমেনে চলমান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নোংরা খেলার অকাট্য প্রমাণ সামনে আসছে।

ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে সিএনএন অনলাইন ১৮ সেপ্টেম্বর একটি এক্সক্লুসিভ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘মেড ইন আমেরিকা’। প্রতিবেদনের শুরুতেই এক বিধ্বস্ত শিশুর ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুটির দিকে তাকানোর উপায় নেই। তার অসহায় মুখভঙ্গি। দুই চোখে জল। মাথা, নাক, কান, চোখ, ঠোঁটসহ পুরো মুখমণ্ডল রক্ত আর ধুলোবালুতে একাকার। তার ছোট্ট শরীরজুড়ে ভয়াবহতার ছাপ।

গত ৯ আগস্ট ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সাদা প্রদেশে একটি স্কুলবাসে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের বিমান হামলায় আহত হয় এই শিশু। অন্তত ৪০ জন শিশু এই হামলায় নিহত হয়। আহত হয় অনেকে।

স্কুলবাসে হামলার স্থানে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি বোমার অংশবিশেষ পাওয়া যায়। গত মাসে সিএনএনের এক অনুসন্ধানে এই তথ্য উঠে এলে হইচই পড়ে যায়। মূলত, এই তথ্যটি ছিল অনেকটা ডুবোপাহাড়ের ভাসমান চূড়ামাত্র।

এবার সিএনএন হাঁড়ির খবর নিয়ে এসেছে। তারা বলছে, শুধু সাদায় নয়, ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে বিভিন্ন হামলার স্থানে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি বোমার অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। আর এসব হামলার প্রতিটিতেই বেসামরিক লোকজন নিহত অথবা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

২০১৫ সালের ২৬ মার্চ ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে সৌদি জোট। হুতিদের নির্মূল করে ইয়েমেনে মানসুর হাদির সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথিত লক্ষ্য নিয়ে সৌদি জোট প্রায় তিন বছর ধরে দেশটিতে নির্বিচারে বিমান হামলা চালাচ্ছ। ইয়েমেনে চলমান সংঘাতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হাজারো। হতাহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই বেসামরিক লোকজন। বেসামরিক লোকদের প্রাণহানির জন্য প্রধানত সৌদি জোটের বিমান হামলাকেই দায়ী করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার।

ইয়েমেনে হামলার ঘটনা নিয়ে সিএনএনের বৃহত্তর অনুসন্ধানে সহায়তা করেছে ইয়েমেনভিত্তিক স্বাধীন মানবাধিকার গোষ্ঠী মওয়াতানা। তারা সব পক্ষেরই সহিংসতার তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে।

ইয়েমেনে বিভিন্ন হামলার স্থানে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্রের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। ছবি: মওয়াতানা
ইয়েমেনে বিভিন্ন হামলার স্থানে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্রের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে। ছবি: মওয়াতানা

মানবাধিকার গোষ্ঠীটি প্রশিক্ষিত মাঠপর্যায়ের গবেষকদের মাধ্যমে হামলার স্থানের আলামতের ছবি সংগ্রহ করে। ঘটনাস্থলে পাওয়া অস্ত্রের অংশবিশেষের ছবি থেকে অস্ত্র শনাক্তে গোষ্ঠীটি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক অস্ত্র বিশেষজ্ঞকে দিয়েও ছবিগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিটি ঘটনাতেই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে।

সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে ইয়েমেনে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ১১টি হামলার ঘটনা প্রমাণসহ উপস্থাপন করে। সব কটি হামলাই জোট চালায়। এসব হামলায় যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্র ব্যবহৃত হয়।

ইয়েমেনে সামরিক অভিযানে সৌদি জোটকে সমর্থন দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা অভিযানে সহায়তাও করছে। সৌদি আরবের যুদ্ধবিমানকে জ্বালানি সরবরাহ ও গোয়েন্দা তথ্য দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি তো আছেই।

মাস কয়েক আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ উঁচু গলায়ই জানান, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা সৌদি আরব। এই অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে তাদের শত শত কোটি ডলার আয় হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রই এখন ইয়েমেন যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইয়েমেনে নিয়মিত শিশুসহ নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরছে। মানুষের প্রাণ যাচ্ছে অকাতরে। এই অবস্থার আইনগত ও নৈতিক দায় যুক্তরাষ্ট্রেরই। কিন্তু এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘টুঁ’ শব্দটি পর্যন্ত নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা যুক্তি, ইয়েমেনে হামলার লক্ষ্যবস্তু তো তারা নির্ধারণ করে না। নির্ধারণ করে সৌদি জোট।

বোঝাই যাচ্ছে, ইয়েমেন যুদ্ধে কত প্রাণ বলি হলো, সেখানে মানবাধিকার আছে, নাকি গোল্লায় গেছে—এসব নিয়ে ভাবার কোনো ‘টাইম’ যুক্তরাষ্ট্রের নেই। কারণ, যুদ্ধ চললে মার্কিন অস্ত্রের বিকিকিনি জমজমাট হয়। ভূরি ভূরি ডলার আসে। আর কী চাই!

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]