দূষণ ও মৃত্যু

২০১৫ সালে বাংলাদেশে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে পরিবেশদূষণজনিত অসুখ–বিসুখে। সংখ্যাটা বিরাট, ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ১০ গুণ। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যত শোরগোল হয়, পরিবেশদূষণ নিয়ে ততটা হয় না। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে পরিবেশদূষণের কুফল তেমন প্রত্যক্ষ নয় বলে এটা সম্পর্কে জনসচেতনতার প্রকট ঘাটতি আছে। এটা যে একটা গুরুতর জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে, এই বাস্তবতা সম্পর্কে নীতিনির্ধারক মহলেও উপলব্ধির অভাব আছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে পরিচালিত একটি সমীক্ষার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের পরিবেশ সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া গেল, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পরিবেশদূষণের ফলে আমাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি উদ্বেগজনক মাত্রায় বেড়ে চলেছে।

‘বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীল উন্নয়নের সুযোগ বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে মোট যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ২৮ শতাংশই মারা গেছেন পরিবেশদূষণজনিত নানা অসুখ–বিসুখে। এটা অতি উচ্চ হার, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ এবং বৈশ্বিক হারের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। এটা বেশ উদ্বেগের বিষয়। কারণ পরিবেশদূষণ অনিবার্য প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া নয় যে মানুষের পক্ষে তা এড়ানো বা ঠেকানো অসম্ভব। বরং মানুষের নানা রকমের কর্মকাণ্ডের ফলেই প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ঘটছে, তার ফলে আমরা অসুখ–বিসুখে ভুগে মারা যাচ্ছি, আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে; সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের শিশুরা। দেশের শহরগুলোতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সিসাদূষণের ঝুঁকিতে বসবাস করছে, তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু আছে। সিসাদূষণ শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এতে তাদের মেধা ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত হয়।

পরিবেশদূষণের ফলে আমাদের শহরগুলোতে বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ ক্ষতিকর মাত্রায় বেশি। খোলা পরিবেশে তো বটেই, ঘরের ভেতরের বাতাসও দূষিত। এ ছাড়া পানিদূষণ একটা বড় সমস্যা, নিরাপদ পানি দুর্লভ। বাতাস ও পানি—এই দুটি উপাদানের দূষণ ঘটলে হলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে; সামগ্রিক স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতি ঘটে। আমাদের বাড়তি সমস্যা পরিচ্ছন্নতার অভাব; বর্জ্যব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, স্যানিটেশনের নিম্নমান, শিল্পকারখানার কাজের পরিবেশেও দূষণের মাত্রা বেশি।

পরিবেশদূষণের কারণে মানুষের মৃত্যু অপমৃত্যু নয়। ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সবই সমাধানযোগ্য। সমাধান করতে হলে আন্তরিকভাবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ তৎপরতা প্রয়োজন। পরিবেশ অধিপ্তরের গতানুগতিক কর্মসূচিগুলো ফলপ্রসূ নয়। পরিবেশবিষয়ক আইন ও বিধানগুলোর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। শিল্পকারখানা স্থাপনের সময় পরিবেশ সুরক্ষার বিধান অনুসরণ নিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোরও দায়িত্ব অনেক; শহরাঞ্চলের পরিচ্ছন্নতা রক্ষার প্রধান দায়িত্ব তাদেরই। জনসাধারণের সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতারও বিকল্প নেই।