ভোট হবে, গণতন্ত্র বাঁচবে তো!

গতকাল সকালে একজন মানবাধিকারকর্মী টেলিফোনে সাগ্রহে জানতে চাইলেন নির্বাচনের বিষয়ে নাকি সমঝোতা হয়ে গেছে? তাঁর কাছে জানতে চাই, কী রকম সমঝোতা? তিনি বললেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব দলের নেতারা শপথ নিয়ে বলেছেন, তাঁরা আর মারামারি, কাটাকাটি করবেন না। শান্তিপূর্ণভাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবেন। এই ভদ্রলোক দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। বিদেশে থাকতেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। তাঁর উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ গত সোমবার ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘শান্তিতে বিজয়’ প্রচারাভিযান। এতে সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, বিদেশি কূটনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির উপস্থিতি তাঁকে আরও উৎসাহিত করেছে। পত্রিকার খবর থেকে জানা গেল, ওই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ দেশের ৪০ জেলা থেকে আসা ৪০০ রাজনীতিক ‘সহিংসতামুক্ত’ শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের শপথ নিয়েছেন। ডুবন্ত জাহাজে থাকা যাত্রী যেমন খড়কুটো ধরে বাঁচতে চেষ্টা করেন, তেমনি বিবাদে-বিদ্বেষে ক্লান্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ ধরনের আয়োজন দেখলে কিছুটা আশান্বিত হয়।

শপথ গ্রহণের আগে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান সহাস্যে করমর্দন করেছেন। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তাঁরা। সরকারি দলের নেতারা বরাবর বিরোধী দলের সঙ্গে কোনোরকম সংলাপ বা সমঝোতাকে তাঁদের রাজনৈতিক পরাজয় বলে মনে করেন। তাঁরা বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে তখনই কথা বলেন, যখন বিদেশিরা আমন্ত্রণ জানান। গণতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা দেশের মাটিতে কথা বলেন না। কিন্তু ব্রিটিশ বা ইউরোপীয় পার্লামেন্টে শুনানিতে অংশ নেন। এখানেও দুই দলের দুই নেতাকে করমর্দন করতে দেখলাম ইউএসএইড ও ইউকেএইডের সহায়তায় পরিচালিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল আয়োজিত অনুষ্ঠানে। আমরা বিদেশিদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিতে পারি, প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য হাত বাড়াতে পারি; কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে যে দেশটির জন্ম, সেই দেশটির গণতন্ত্র ও নির্বাচনে বিদেশিদের সহায়তা নিতে হবে কেন? কেন আমাদের সমস্যাগুলো আমরা নিজেরা সমাধান করতে পারছি না? এই প্রশ্নের জবাব রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই দিতে হবে।

সংবিধান অনুযায়ী জনগণই বাংলাদেশের মালিক। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও এই মালিকানা তারা কতটা পেয়েছে, তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষিত হয়েছে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণকে যতই ছলনায় ভোলাক না কেন, তারা সব সময় তাদের প্রতি আস্থা রেখেছে; তাদের আহ্বানে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নূর হোসেন, তাজুল, সেলিম, দেলোয়ারসহ বহু মানুষ জীবন দিয়েছেন। কিন্তু সেই গণতন্ত্র এখনো অধরাই রয়ে গেছে। আমরা যদি সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারতাম, তাহলে পতিত স্বৈরাচার নিয়ত আমাদের গণতন্ত্রের সবক দিতে পারতেন না।

রাজনীতিকেরা কথা রাখবেন, অতীত সরকারের গ্লানি-ক্লেদ ভবিষ্যতের সরকার বহন করবে না—এই ভরসায় জনগণ প্রতিবার বাক্স ভরে ভোট দেয়, কাউকে বিজয়ী করে, ক্ষমতায় বসায়; কিন্তু যাঁরা ভোটে জয়ী হন তাঁদের দলীয় পরিচয় বদল হলেও চরিত্র বদল হয় না। এ কারণেই নির্বাচন এলে ক্ষমতাসীনদের হৃৎকম্পন শুরু হয়ে যায়। ভোটে জিততে নানা রকম কৌশল-অপকৌশলের আশ্রয় নেন। তাঁদের হাতে সংসদ আছে, থানা-পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে, যা দিয়ে তাঁরা দেশ শাসন করেন। আর যারা দেশের মালিক, অর্থাৎ জনগণের কাছে একটি ভোট ছাড়া কিছুই নেই।

রাজনীতিকেরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশকে বিশ্বে রোল মডেল বা অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রচার করতে পছন্দ করেন। কিন্তু কেন তাঁরা গণতন্ত্র কিংবা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সে রকম কোনো মডেল চালু করতে পারলেন না? একসময় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের ‘উদ্ভাবিত’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহির্বিশ্বে রপ্তানির কথা বলতেন। এখন তাঁরা ভুলেও সেসব কথা মুখে আনেন না। জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে বিএনপির নেতারা জাতিসংঘে গিয়েছিলেন বলে তাঁরা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। আন্দোলনে হতাশ হয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন বলে উপহাস করতেও দ্বিধা করছেন না। এত দিন বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা নির্বাচন বানচাল ও আগুন-সন্ত্রাসের রাজনীতি করে। সেই আগুন-সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে যদি দলটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জাতিসংঘে ধরনা দিয়ে থাকে, তাকে বাঁকা চোখে দেখার সুযোগ নেই। বরং আওয়ামী লীগ নেতারা বলতে পারতেন, বিএনপির জাতিসংঘে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা প্রয়োজন, আমরা করব। অতীতে বিএনপি ভুল করে থাকলে তার প্রতিকার নিশ্চয়ই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে পারে না।

বিএনপি নেতারা মুখে নির্দলীয় সরকারের কথা বললেও তাঁদের হাবভাবে মনে হচ্ছে ভোটের ন্যূনতম পরিবেশের নিশ্চয়তা পেলে তাঁরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত আছেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের বলটি এখন পুরোপুরি সরকারের কোর্টে। তারা যদি সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। গণতন্ত্র রক্ষা পাবে। তারা যদি অ-সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, নির্বাচন অ-সুষ্ঠু হবে। নির্বাচনের সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জনপ্রশাসন তাদের কথার বাইরে যাবে না। নির্বাচন কমিশন তাদের ইশারায় চলছে। এ অবস্থায় হয়তো বিএনপির প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। তারপরও মনে হচ্ছে বিএনপি নির্বাচনের বাইরে কিছু ভাবছে না। ভাবার সুযোগও নেই। কিন্তু নাটকের পরের অংশের মঞ্চায়ন কেমন হবে, সেই নাটক দর্শকদের আকৃষ্ট করবে না বিমুখ করবে, সেটি নির্ভর করছে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর। আওয়ামী লীগের মনে রাখা উচিত, তাদের দাবির মুখেই কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান ১৯৯৪ সালে নির্বাচনী সংকট কাটাতে ঢাকায় এসেছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে তিনি সমঝোতার একটি উপায়ও বাতলেছিলেন, যা আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি এবং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করেই ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে গিয়েছিল। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ফার্নান্দেজ তারানকোও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে বসেছিলেন নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। তাঁর উদ্যোগ সফল হয়নি। বিএনপি দাবি মানাতে না পেরে নির্বাচন বর্জন করেছিল। সেটি আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ হয় এবং প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা জয়ী হয়। এবার নিশ্চয়ই বিএনপি নির্বাচন ঠেকানোর মতো হঠকারী পথ বেছে নেবে না। বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে, রাজনৈতিক মহলে এই গুঞ্জন চাউর হতেই নতুন করে মামলা ও নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় অশনিসংকেত বলেই মনে করেন রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

গতকালের পত্রিকায় দেখলাম, ভয়ভীতি সত্ত্বেও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা তো অনেক আগে থেকে ভোটের মাঠ সরগরম করে রেখেছেন। এখন যেটি জরুরি তা হলো সবার জন্য ‘খেলার মাঠ’ সমান করা। কারও হাত-পা বেঁধে আপনি বলতে পারেন না সাঁতার কাটুন। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। যদিও বাংলাদেশের ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। বিরোধী দল ছাড়াই জাতীয় সংসদের অর্ধেক মেয়াদ চলেছে (বর্তমান দশম সংসদে সেই সুযোগও ছিল না, কেননা সেখানে প্রকৃত অর্থে কোনো বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। কথাটি একাধিকবার বলেছেন সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ) বিরোধী দলের বর্জনের মধ্যে। আর যে দল নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে, তারা সবকিছু দখল করে নেয়।

গণতন্ত্রের এই অসুস্থ ধারার সঙ্গে জনগণের ভোটের অধিকারটুকুও যদি না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের কী থাকল? সংবিধান অনুযায়ী ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে, সংসদ গঠিত হবে এবং সেই সংসদ সরকারও গঠন করবে। কিন্তু গণতন্ত্র বাঁচবে তো?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]