জঙ্গিরা নিবৃত্ত হলেও জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়নি

দণ্ডিত তিন জঙ্গিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। এটি কি নিছক দুর্ঘটনা, না জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি? পড়ুন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মন্তব্য

দণ্ডিত তিন জঙ্গিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়
দণ্ডিত তিন জঙ্গিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়

বাংলাদেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূূল হয়েছে, এমন কথা আমরা কখনো বলিনি। যদি কেউ বলে থাকেন, তাঁরা সত্য বলেননি। কাউন্টার টেররিজম ও অ্যান্টি টেররিজম দুটি আলাদা বিষয়। অ্যান্টি টেররিজম বা সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের নির্মূল করা যায়, তাদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু তাদের যে আদর্শ বা দর্শন—জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হবে উন্নত রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে।
একসময় বলা হতো বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নেই—এসব গণমাধ্যমের সৃষ্টি। তাদের এই প্রচারণা যে সত্য ছিল না, তার প্রমাণ জঙ্গিরাই দিয়েছে বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে, এক দিনে দেশের ৬৩টি জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে। এরপর যখন জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার হলো, শীর্ষ জঙ্গিদের ফাঁসি দেওয়া হলো, তখন জঙ্গিরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল। গত সাত বছরে বিভিন্ন জঙ্গি ঘাঁটিতে অভিযান চালানো এবং গ্রেপ্তার ও বিচারের মাধ্যমে জঙ্গিদের কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু একেবারে নির্মূল যে করা যায়নি, দণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনাই তার প্রমাণ।
এই জঙ্গিবাদ নির্মূল করার প্রধান উপায় হলো, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি আইনের শাসন এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা। একই সঙ্গে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐকমত্য সৃষ্টি করা নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের মানুষকে সক্রিয় রাখাও জরুরি। সমস্যাটি মোকাবিলা করতে হবে সার্বিক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিতে, দলীয়ভাবে দেখলে হবে না। মনে রাখতে হবে, এটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সমস্যা নয়; জাতীয় সমস্যা। আর এই জাতীয় সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠেই সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে ২০০৪-০৫ সালে যখন দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে, তখন একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। বিভিন্ন দেশে জঙ্গিগোষ্ঠী রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভাজনের সুযোগ নিয়ে থাকে। তবে আশার কথা, গত দুই বছরে সেই রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও জঙ্গিগোষ্ঠী সুবিধা করতে পারেনি। এতে প্রতীয়মান হয় যে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। আবার এ কথার অর্থ এই নয় যে তারা নির্মূল হয়ে গেছে।
আমাদের এও মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশে অবস্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষ করে যারা জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি এবং হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে জড়িত, তাদের বেশির ভাগই আফগানিস্তান-ফেরত। তারা সেখানে গিয়েছিল সাবেক সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে। সেখানে তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। যখন দেশটি থেকে সোভিয়েত বাহিনী বিতাড়িত হলো, তখন আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন বললেন, তোমরা নিজ নিজ দেশে গিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করো। কিন্তু এই জঙ্গিগোষ্ঠী উপলব্ধি করতে পারেনি যে আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ এক নয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান পরমতসহিষ্ণু। তারা এখানে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি গাড়তে দেবে না।
তা ছাড়া এই জঙ্গিদের কোনো আদর্শ নেই। তারা ইসলামি শাসনের কথা বলছে, কিন্তু ইসলামে তো বোমা মেরে মানুষ মারা কিংবা সন্ত্রাস সমর্থন করে না। এসব কারণেই জঙ্গিরা জনগণের সমর্থন পায়নি। বরং তারা এই সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
সম্প্রতি কাশিমপুর জেলখানা থেকে ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়ার পথে তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের যে ঘটনা ঘটেছে, সেটিকে আমি খুব আতঙ্কের মনে করি না। এটি ছিল তাদের ‘সফট টার্গেট’। তারা নিজেদের সহযোগীদের উদ্ধার করতে চেয়েছিল। আবার এই ঘটনা এও প্রমাণ করে যে, জঙ্গিদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস এখনো অটুট আছে। তারা এই অভিযানে যে দুটি গাড়ি ব্যবহার করেছিল, তার একটি নতুন। এ রকম একটি গাড়ির দাম ৩০-৩৫ লাখ টাকা। সেই টাকাটি তারা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। এই কাজটি করতে তাদের বেশ প্রস্তুতিও নিতে হয়েছে। এসব টের না-পাওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতা বলে মনে করি। তার চেয়েও উদ্বেগজনক হলো এ রকম তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, তা ছিল অত্যন্ত নাজুক। তা ছাড়া পুলিশ সদস্যদের নৈতিক মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেখানে তাঁরা নির্বিচারে ঘুষ-দুর্নীতির কারবার করছেন, সেখানে এ রকম ঘটনায়ও আর্থিক লেনদেনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শাহিদুল আনাম খান: নিরাপত্তা বিশ্লেষক।