সাবধান! শ্রম আইনে শুভংকরের ফাঁকি

মধ্যম আয়ের দেশে শ্রমিকের মজুরি ও অধিকার আরও সংকুচিত হবে কেন? ছবি: প্রথম আলো
মধ্যম আয়ের দেশে শ্রমিকের মজুরি ও অধিকার আরও সংকুচিত হবে কেন? ছবি: প্রথম আলো

আর্থসামাজিক বাস্তবতা, ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, পরিবর্তিত পরিস্থিতি, যুগোপযোগীকরণ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রয়োজনে আইনকানুন সংশোধন করা হয়। ২০০৬ সালের শ্রম আইন সংশোধনের অঙ্গীকার অনেক দিনের। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রায় বছর তিনেকের চেষ্টার ফলাফল বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮ এখন সংসদদের ‘হ্যাঁ’ ভোটের অপেক্ষায়। আজকালের মধ্যেই হয়তো আমরা শুনব ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হইল’ ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হইল’ ‘হ্যাঁ জয়যুক্ত হইল’। সংশোধন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সবার দাবি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর যেসব ক্ষেত্রে অনেক কষ্টে সহমত হওয়া গেছে, শুধু সেগুলোকেই সংশোধনীতে আনা হয়েছে। এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের খেটে খাওয়া শ্রমিকদের উদারতায় মুগ্ধ হতে হয়। ভাবতে অবাক লাগে, তাঁরা শ্রমজীবী মানুষের এক নম্বর মানবাধিকার ‘দৈনিক আট ঘণ্টা’ কর্মসময়ের অবস্থা থেকে কেমন করে সরে যেতে রাজি হলেন?

নতুন সংশোধনীতেও সেই পুরাতন দশ ঘণ্টার মারপ্যাঁচ থেকেই যাচ্ছে। অর্থাৎ শ্রমিকের কাজের সময় দশ ঘণ্টা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা যাবে। কিন্তু যদি শ্রমিককে পিস রেটের ভিত্তিতে (ঠিকা হার, কাজ অনুযায়ী মজুরি) মজুরি দেওয়া হয়, তাহলে আর আট-দশ ঘণ্টার বিধিনিষেধ বলে কিছু থাকবে না। বলা বাহুল্য, উৎপাদন, এমনকি সেবামুখী প্রতিষ্ঠানগুলোয় কয় টুকরা উৎপাদন হলো বা কয়জনকে সেবা দিল, তার ভিত্তিতে মজুরি দেওয়ার চল শুরু হচ্ছে। কোথাও কোথাও একটা মাসিক মজুরি রেখে পাশাপাশি পিস রেটও থাকছে, যাতে আট-দশ ঘণ্টার পরেও শ্রমিককে যতক্ষণ খুশি আটকে রাখা যায়। মে দিবসে রক্তদানের মাধ্যমে আট ঘণ্টা কর্মদিনের যে অধিকার বিশ্বের শ্রমিকেরা অর্জন করেছিলেন, বাংলাদেশ কি তার থেকেও পেছনে যাবে?

সবচেয়ে আপত্তিকর সংশোধনী আসছে প্রসূতি নারী শ্রমিকদের নিয়ে। বলা হচ্ছে, ‘কোন মহিলা শ্রমিক প্রসূতি কল্যাণ ছুটিতে যাইবার নির্ধারিত তারিখের পূর্বে গর্ভপাত ঘটিলে তিনি কোনো প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা পাইবেন না। তবে স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটির প্রয়োজন হইলে পাইবেন।’ অনেক সময় প্রসূতি মায়েরা চেষ্টা করেন একেবারে বাধ্য না হলে মাতৃত্বের ছুটিটা প্রসবের পরে যেন নিতে পারেন। সেই কাঙ্ক্ষিত ছুটিতে যাওয়ার আগে গর্ভপাত হয়ে গেলে তাঁকে সব রকমের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার এই প্রবিধান নিতান্তই অমানবিক। তা ছাড়া গর্ভপাতের শিকার নারীদের মানসিক পরিস্থিতি আরও বেশি সহযোগিতার দাবি রাখে।

কোনো মালিক যদি কোনো নারী শ্রমিককে প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন, তাহলে মালিককে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান নতুন সংশোধনীতে রাখা হয়েছে। বলা বাহুল্য, দণ্ড দেওয়ার মালিক আদালত। অর্থাৎ বঞ্চিত নারীকে আদালতের দরজার কড়া নাড়াতে হবে। সারা দেশে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালসহ মোট আটটি আদালতে এখন পর্যন্ত নানা কিছিমের ১৭ হাজার ১২১টি মামলা বছরের পর বছর নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে আছে। তা ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীর বাইরে কোনো শ্রম আদালত না থাকায় বঞ্চিত শ্রমিকদের পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া দুরস্ত। তা ছাড়া ২৫ হাজার টাকার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে সবেতন প্রসূতি ছুটির আর্থিক মূল্য বেশি বৈ কম হবে না। মালিকের কাছে জরিমানা দিয়ে নবজাতকের মাকে চাকরি থেকে বিদায় করে দিয়ে অন্য আরেকজন কোল-খালি নারীকে চাকরিতে নেওয়া অনেক সস্তা ও উৎপাদন-সহায়ক মনে হতে পারে। আইন কি সেই বেরহম চিন্তার সুযোগ করে দিচ্ছে!

আদালতের ওপর চাপ কমানো, শ্রমিকের আর্থিক সংগতি, সময়, কর্মঘণ্টা ইত্যাদি আমলে নিয়ে আদালতের বাইরে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’র প্রস্তাব আইন ও মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠনগুলো দিলেও সেটা বিবেচনায় আনা হয়নি। যদিও এ বিষয়ে বিচারপতি মোস্তফা কামালের সময় থেকে সুপ্রিম কোর্টের আওতাধীন সব আদালতকে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’র এখতিয়ার দেওয়া আছে।

মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ আদালতের নির্দেশনার সূত্র (রিট পিটিশন নং ৫৯১৬/২০০৮) ধরে নারী শ্রমিকদের কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধ ও নিরসনের জন্য অভিযোগ কমিটির বিধান রেখে যে সংশোধিত ধারার প্রস্তাব করেছিল, সেটিও নতুন আইনের প্রস্তাবে আমলে নেওয়া হয়নি। এবারও সেই সনাতন ৩৩২ ধারা বলবৎ থাকছে (কর্মরত নারীর প্রতি এমন কোনো আচরণ করা যাবে না, যা অশ্লীল বা অভদ্রজনিত বলিয়া গণ্য হইতে পারে।) বলা বাহুল্য, অশ্লীল ও অভদ্র আচরণের কোনো সংজ্ঞা বা পরিসরের ব্যাখ্যা ২০০৬ সালে দেওয়া হয়নি। এবারেও তা ঢাক ঢাক গুড় গুড়ই থেকে যাচ্ছে।

কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় আহত-নিহত হলে কী হারে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে? কে দেবে? কীভাবে, কখন দেবে? এসব নিয়ে শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকে নানা বাগ্‌বিতণ্ডা, আইন-বিধি ইত্যাদি হয়েছে, হচ্ছে। তর্ক যে একেবারে মিটে গেছে তা বলা যাবে না। মালিক কম দিলে অখুশি শ্রমিক তাঁর ন্যায্যটা বুঝে নিতে চাইবেন। সাভারের মর্মান্তিক ঘটনার পর আশা করা গিয়েছিল, বাংলাদেশে এবার একটা বিবেকতাড়িত অধিকারভিত্তিক ক্ষতিপূরণব্যবস্থা চালু হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে অভিজ্ঞ ও আস্থাভাজন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটি তার সিদ্ধান্ত আদালতকে জানিয়ে দিয়েছে সময়মতো। তাদের সেই সুপারিশ বিবেচনা না করে মালিকদের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছে নতুন সুপারিশে। কর্মের কারণে নিহত হলে দুই লাখ, আহত হলে আড়াই লাখ! ব্যস, তামাম শোধ! নিহত ও আহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শ্রমিকের অবসর গ্রহণ করা পর্যন্ত তাঁর সম্ভাব্য আয়ের পরিমাণ, অবসর গ্রহণকালে প্রাপ্য গ্র্যাচুইটি ও অন্য আইনানুগ পাওনাদি এবং তাঁর পোষ্য বা পোষদের মানসিক অবস্থা এবং দুঃখকষ্টভোগ বিবেচনায় রাখা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত রীতি। বাংলাদেশ কি বিশ্বের বাইরে থাকতে চায়? আমরা না মধ্যম থেকে উত্তম হওয়ার স্বপ্ন দেখছি? শ্রমিকদের উত্তম-মধ্যম দিয়ে সে পথে আমরা কতটুকু এগোতে পারব?

খসড়া আইনটা নিয়ে এত রাখঢাক কেন? সবার না হোক, শ্রমিকদের সঙ্গে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে বাধা কোথায়?

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।