এক দীর্ঘ জীবনের আন্তরিক বয়ান

অধ্যাপক নূরুল ইসলামের দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ
অধ্যাপক নূরুল ইসলামের দুটি বইয়ের প্রচ্ছদ

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় যেসব স্লোগান ও ফেস্টুন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল, তার একটি হচ্ছে ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম পাঠগুলোতে রাষ্ট্রবিষয়ক আলোচনায় যে কথাটি গুরুত্বপূর্ণভাবে স্মরণ করা হয় তা হচ্ছে, রাষ্ট্র কোনো প্রাকৃতিক বিষয় নয়, তা আপনা-আপনি তৈরি হয় না। রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া শেষ হয় না, রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটে।

যেকোনো রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার একটি শক্তি হচ্ছে জনগণ, রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা রাষ্ট্র গঠনের কাজ করে। তাদের নেতৃত্ব দেন রাজনীতিবিদেরা; তাঁরা আদর্শিকভাবে দিকনির্দেশনা দেন। রাষ্ট্র গঠনের আরেকটি দিক হচ্ছে নীতি নির্ধারণ করা, পরিকল্পনা করা, তার বাস্তবায়নের কাঠামো গড়ে তোলা, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। সেই কাজে যাঁরা যুক্ত থাকেন তাঁরা রাজনীতিবিদ নন; রাজনৈতিক সচেতনতা দিকনির্দেশনার কাজ করলেও তাঁদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান দিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের কাজে নিয়োজিত হন।

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এবং গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে রূপান্তর ঘটেছে, সেটাকে ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ করা যাবে না। এই রূপান্তর প্রক্রিয়া জানা যায় ইতিহাসের ধারাবাহিক বর্ণনা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ আলোচনা থেকে। এর বাইরে আরেকটি বড় উপাদান হচ্ছে সেই সব ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, যাঁরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে কারণেই আত্মজীবনী ইতিহাসের অন্যতম উপাদান। অধ্যাপক নূরুল ইসলামের সম্প্রতি প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক বই অ্যান অডিসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ (প্রথমা, ২০১৭) সে কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই বই স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এটি তাঁর পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থ মেকিং অব আ নেশন—বাংলাদেশ: অ্যান ইকোনমিস্টস টেল (ইউপিএল, ২০০৩)-এর সম্পূরক গ্রন্থ। এই দুটি বই একত্রে পাঠ করলে আমরা বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের দুটি পর্যায়কে গভীরভাবে বুঝতে পারব।

অধ্যাপক নূরুল ইসলাম স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান বা উপপ্রধান ছিলেন ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালে। কিন্তু সেটা তাঁর একটি পর্যায়ের পরিচিতিমাত্র, সেই সময়ে তিনি প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র গঠনের সেই পর্বের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেটা নীতি প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠান তৈরির সময়কাল। তিন ভাগে বিভক্ত মেকিং অব আ নেশন গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগকে তিনি সেভাবেই চিহ্নিত করেছেন—‘বিল্ডিং আ স্টেট’। কিন্তু আমার ধারণা ওই বইয়েরই প্রথম পর্ব, ‘বার্থ অব নেশন’ অংশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে বঞ্চিত হচ্ছেন, তার তথ্যভিত্তিক ভিত্তিভূমি তৈরি করেন, দুই অর্থনীতির তত্ত্বের যে যুক্তি তৈরি করেন, সেটা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গঠনের কেবল প্রথম পদক্ষেপই নয়, একই সঙ্গে তার মধ্যেই আছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শের বীজ—সেটা হচ্ছে বৈষম্যের অবসান। তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ অ্যান অডিসির পূর্বকথায় তিনি বলেছেন ‘ন্যায়বিচার এবং মুক্তির’ জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর যুক্ত থাকার কথা। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এই অঙ্গীকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত আছে, কিন্তু তা যে অকস্মাৎ যুক্ত হয়েছে তা নয়, অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বই দুটি পাঠ করলে তা বোঝা সহজ হয়।

ন্যায়বিচার এবং মুক্তির জন্য অধ্যাপক নূরুল ইসলামের সেই প্রচেষ্টার সূচনা হয় ১৯৫৫/৫৬ সালে। তিনি পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বিষয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অর্থনীতিবিদের সঙ্গে একত্রে তৈরি প্রতিবেদনে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যকে চিহ্নিত করেছেন; ১৯৬০ সালে গঠিত দ্রব্যমূল্যবিষয়ক কমিশনের সদস্য হিসেবে ভূমিকা নিয়েছেন। ১৯৬১ সালে ফাইন্যান্স কমিশনের পূর্ব পাকিস্তান প্যানেলের সদস্য হিসেবে এবং ১৯৬৪ সালের পরে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস (পিআইডিই) প্রধান হিসেবে তাঁর এই ভূমিকা অব্যাহত থাকে। এসব প্রচেষ্টা পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের ক্ষুব্ধ করেছে এবং তাঁকে সে জন্য বিরূপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়েছে (অ্যান অডিসি, চতুর্থ অধ্যায়)। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা তাঁকে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখতে পারেনি, এই কাজের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যা বিরাজমান রাজনৈতিক-অর্থনীতি বুঝতে সাহায্য করবে। যার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে ১৯৭০ সালে পিআইডিইকে করাচি থেকে ঢাকায় স্থানান্তর।

১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধানের পদে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন (অ্যান অডিসি, পৃষ্ঠা ১২০-১২২), কেননা ইতিমধ্যে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন হয়ে ছয় দফা বাস্তবায়নের কর্মকৌশল তৈরির দিকে মনোযোগ দিয়েছেন; তদুপরি তিনি এই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন যে প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক রক্ষার আর কোনো উপায় অবশিষ্ট নেই।

অধ্যাপক নূরুল ইসলামের জীবনের যে অধ্যায় সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত ও আলোচিত, তার সময়কাল স্বল্প কিন্তু গুরুত্ব অপরিসীম। তা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান হিসেবে তাঁর এবং কমিশনের ভূমিকা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রাতিষ্ঠানিক পর্বের সূচনা বলেই আমরা সেই সময়কে বিবেচনা করতে পারি। তাঁর মেকিং অব আ নেশন গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশের আটটি অধ্যায়ের সাতটিই এই বিষয়ে; অ্যান অডিসি গ্রন্থের সবচেয়ে দীর্ঘ অধ্যায় হচ্ছে পঞ্চম অধ্যায়, যা তাঁর ওই সময়ের অভিজ্ঞতার অনুপুঙ্খ এবং গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা। এসব অধ্যায়ে বিবৃত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সারাংশ সংক্ষেপে তুলে ধরা একাদিক্রমে অসম্ভব এবং অনুচিত, কেননা এই কথাগুলো অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বয়ানেই শোনা জরুরি। কিন্তু এসব অধ্যায়ে, বিশেষত অ্যান অডিসি গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি যে বহুল আলোচিত প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন, তার মধ্যে আছে পরিকল্পনা কমিশন কি আসলেই সব মন্ত্রণালয়ের ওপরে এক ‘সুপার-মিনিস্ট্রি’তে পরিণত হয়েছিল? প্রধানমন্ত্রী কি কেবল পরিকল্পনা কমিশনের পরামর্শেই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন? এবং কেন তিনি এবং তাঁর সহকর্মী আনিসুর রহমান, মোশাররফ হোসেন, রেহমান সোবহান একে একে কমিশন থেকে পদত্যাগ করলেন? অধ্যাপক ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশন একটি রাজনৈতিক সরকারের সমান্তরাল সরকার হিসেবে কাজ করেনি (পৃষ্ঠা ১৬১-১৬২; পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৮)। কিন্তু অতীতে এ ধরনের অভিজ্ঞতার অভাবই হচ্ছে প্রশাসন বা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে কমিশনের বিরোধের কারণ।

কমিশনের সদস্যদের একে একে কমিশন থেকে পদত্যাগ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যে আমরা দেখতে পাই যে ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শেষ হওয়ার পরই কমিশনের সদস্যরা পদত্যাগের কথা বিবেচনা করেন এবং কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীকে তা অবহিত করেন (পৃষ্ঠা ১৯৫)। তবে তিনি এটাও জানান যে কমিশনের সদস্যরা তাঁদের নীতি, কর্মসূচি এবং দিকনির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদদের রাজি করাতে পারছিলেন না, যে ধরনের অ্যালায়েন্স তৈরি করা দরকার ছিল সেটা করার মতো দক্ষতা বা মানসিক ধাত তাঁদের ছিল না।

পরিকল্পনা কমিশনে তাঁর এই অভিজ্ঞতা ও পরিবর্তনগুলোকে এভাবেও দেখার সুযোগ আছে যে ১৯৭২ সালে যে রাষ্ট্র তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল, অন্ততপক্ষে কমিশনের সদস্যরা যেভাবে ভেবেছিলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির সেই রাষ্ট্র গঠনের শক্তি ছিল না, একইভাবে প্রশাসনিক কাঠামো বা আমলাতন্ত্রের সেই প্রস্তুতি ও আগ্রহ ছিল অনুপস্থিত। ফলে কমিশনের সঙ্গে অন্যদের বিরোধ হচ্ছে কী ধরনের রাষ্ট্র তৈরি করা হবে সেই প্রশ্নে। ১৯৭২ সালে যে রাষ্ট্র গঠনের কথা ভেবে কমিশন গড়া হয়েছিল, ১৯৭৪ সালে সেই অবস্থা বদলে গিয়েছিল। অবশ্যই রাষ্ট্রের রূপান্তর সেখানেই শেষ হয়নি, তা অব্যাহত থেকেছে এবং এখন এমন এক রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, যা ‘মেরামতের’ দাবি উঠেছে কিশোর-তরুণদের কাছে থেকেই।

এই দুই বইয়েই লেখক অনেক ছোট ছোট ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যেগুলো তাঁর ভাষায় ‘ইনসিডেন্টস’; কিন্তু সেগুলো কেবল তাঁর স্মৃতিকথা হিসেবে উল্লেখিত হয়নি, সেগুলোকে তিনি বৃহত্তর ঘটনাধারার মধ্যেই স্থাপন করেছেন। এ রকম অনেক ঘটনার বিষয়ে পাঠকের আগ্রহ হবে এই কারণেও যে এসব ঘটনার মধ্যে পরে সংঘটিত অনেক কিছুর ইঙ্গিত আছে, ইঙ্গিত আছে আজকের বাংলাদেশের অনেক অজানা বিষয়েরও। যেমন তাঁর মেকিং অব আ নেশন গ্রন্থের সপ্তম অধ্যায়ে তিনি খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাঁর কিছু স্মৃতির উল্লেখ করেছেন (পৃষ্ঠা ১৬৩-১৬৯)। তাঁর অ্যান অডিসি গ্রন্থের সূত্রে আমরা জানতে পারি যে তিনি জিয়াউর রহমানের প্রথম সাক্ষাৎ পান ১৯৬৬ সালে অ্যাবোটাবাদে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি সফরের সময়, জিয়া তখন একাডেমির একমাত্র পূর্ব পাকিস্তানি সেনা প্রশিক্ষক (পৃষ্ঠা ১১২); তবে তাঁদের মধ্যে কোনো কথাবার্তা হয়নি। স্বাধীনতার পরে যখন ইসলাম পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান, সেই সময়ে তাঁদের সাক্ষাতের আরও ঘটনা আছে। কিন্তু যে সাক্ষাতের বিষয়ে ইসলাম আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন, সেটি ১৯৭৪ সালে যখন তিনি পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সেই সময় জিয়া অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে পদত্যাগ না করার অনুরোধ করেন এবং বলেন, বাংলাদেশ সমৃদ্ধিশালী দেশ হবেই এবং অচিরেই অধ্যাপক ইসলাম কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই তাঁর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন। অধ্যাপক ইসলাম জিয়ার আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বরে বিস্মিত হয়েছিলেন, যেমন হয়েছিলেন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ে কথাবার্তায়। অ্যান অডিসি গ্রন্থে এ ধরনের একটি ঘটনা হচ্ছে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে দেশে ফেরানোর জন্য ১৯৭২-১৯৭৩ সালে চেষ্টায় অসাফল্য। ইসলাম জানাচ্ছেন, তিনি অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে অনুরোধ করেছিলেন যেন এ এম এ মুহিতকে বিশ্বব্যাংক এবং পরে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ না করে দেশে প্রশাসনে যুক্ত করেন; মুহিতকে পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেওয়ার জন্যও তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন তা বাস্তবায়িত হয়নি, ইসলামের কাছে সেটি রহস্যময় মনে হয় (পৃষ্ঠা ১৪৫-১৪৬)। এ এম এ মুহিত দেশে ফেরেন ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে।

অ্যান অডিসি: দ্য জার্নি অব মাই লাইফ অধ্যাপক নূরুল ইসলামের দীর্ঘ এবং সফল কর্মজীবনের ঘটনাপ্রবাহের আন্তরিক বিবরণ। শিক্ষা ও কর্মজীবনের সূত্রে তাঁকে দেশ থেকে দেশান্তরে যেতে হয়েছে; গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানে; শিক্ষক, সহপাঠী ও ছাত্র হিসেবে সান্নিধ্য পেয়েছেন কৃতী অর্থনীতিবিদদের; দেশের ও দেশের বাইরের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, সেই সব ঘটনা তিনি আন্তরিকভাবেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। মেধাবী একজন মানুষের কর্মজীবনের ঘটনাপ্রবাহ এই বইয়ের মুখ্য বিষয় হলেও এর পাতায় পাতায় অর্থনৈতিক নীতি, কৌশল, উন্নয়ন বিষয়ে তাঁর প্রজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট। সে কারণে এসব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যাঁরা একমত হবেন না, তাঁদেরও বইটি পাঠ করা দরকার।

কিন্তু এসবের পাশাপাশি তাঁকে আমরা পাই একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে, তাঁকে আমরা দেখি একজন ব্যক্তি হিসেবে, যাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে বিরূপ সময়, মোকাবিলা করতে হয়েছে অপ্রয়োজনীয় সমালোচনা, প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে ভুল বোঝার ঘটনা। সম্ভবত সংবেদনশীলতার কারণেই তাঁর এই গ্রন্থের উপসংহারে ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে যোগদানের সিদ্ধান্ত বিষয়ে এখন তাঁর মনে একধরনের দোটানার কথা বলেন; বলেন, অনেক সময় মনে হয় যে এই সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। সেই সময় বিশ্বব্যাংকের পরিচালক হিসেবে যোগদানের সুযোগ প্রত্যাখ্যান করা ঠিক হয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন তাঁর মনে জাগে।

এসব ভাবনা, তাঁর জীবনের বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এবং দীর্ঘ প্রবাসজীবন যাপন সত্ত্বেও এই আত্মজীবনী আমাদের কাছে যে অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে পরিচয় করিয়ে দেয়, তাঁর হৃদয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আছে একটি সংহত, সফল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। তাঁর এই আকাঙ্ক্ষা তাঁর একার নয়, যে তরুণেরা সম্প্রতি রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলেছিলেন, তাঁরাও স্লোগান তুলেছিলেন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, সবার অংশগ্রহণমূলক, সংহত ও সফল রাষ্ট্র, ‘ন্যায়বিচার ও মুক্তির’ আদর্শই তাঁদেরও অনুপ্রেরণা। অধ্যাপক নূরুল ইসলামের বইগুলো এ কারণেই এখন আরও প্রাসঙ্গিক।

 আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর