বন্ধু, তোমাকে বলি: দুঃখ করো কিন্তু বাঁচো

এটাই কি আমাদের সময়? কতজনের জীবনের সময়ঘড়িতে ঝুরঝুর বালি ঝরে যাওয়া দেখে আঁতকা লাগে আজকাল। সিনেমায় দেখেছিলাম, সন্তানকে নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন এক মা। ছেলে যাতে শব্দ না করে তাই অবুঝ সন্তানের মুখ হাত দিয়ে চেপে রেখেছিলেন সেই নারী। ঘাতকেরা চলে গেলে মা দেখলেন, সন্তানের জীবন বাঁচাতে যেভাবে তার মুখ চেপে ধরেছিলেন, তাতেই দমব্ধ হয়ে মারা গেছে সে। তেমনি করে নিজেকে বাঁচানোর চাপে-তাপে স্বয়ং-হত্যা হয়ে যাচ্ছে আমাদের অনেক মানুষ।

আমাদের সমবয়সী যারা তাদের যৌবনের গত বারটা বছর কেমন পরিবেশে কেটেছে, তা বলা বারণ। রাজনৈতিক হানাহানি, জরুরি অবস্থা, পেট্রল বোমা, চাপাতি, ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধ, গণতন্ত্রহীনতা আর রাষ্ট্রশক্তির নিষ্ঠুর প্রতাপের মধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা। ঢাকা নাকি বিশ্বের সেরা মানসিক চাপের শহর। ঢাকা তো একটা এলাকামাত্র, সারা দেশের কিশোর-যুবরা কেমন আছে? বেকারত্ব ও নেশা, ভয় ও বিভেদ আর পাড়া-শহর-ক্যাম্পাসে ‘সাধারণ’ যারা, তারা যেন নিজভূমে পরবাসী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। আর যারা এ সময়ে বড় হলো, যাদের বয়স ১২-১৮, তারা জানল ভোগান্তির অপর নাম বাংলাদেশ। তারা জানলই না, কৈশোর-তারুণ্য কতটা সহজ আর আনন্দময় হতে পারে।

রাজধানীর প্রখ্যাত আড্ডাস্থলগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মফস্বলের অবস্থাও তথৈবচ। সবখানেই প্রেম নিষিদ্ধ, কিশোর-তরুণেরা সন্দেহভাজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবির হাট—সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা নিষেধ। শাহবাগ মোড়ে প্রায়শই সন্ধ্যার পর আড্ডায় হয়রানি চলে। টিএসসির চায়ের দোকানগুলি বন্ধের চেষ্টা হয় প্রায়ই। ছাত্রাবাসগুলির সঙ্গে মুরগির খোঁয়াড়ের তুলনা চলে। ফেসবুকে মন খুলে কথা বলা যায় না। যৌনতায়ও বাধা, মৌনতেও অসুবিধা—কেননা গুটিয়ে গেলেন তো আপনি হারিয়ে গেলেন।

সমাজ ভেঙ্গে যাচ্ছে। এই ভাঙন প্রথমে ঘটে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের মধ্যে। বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার হিসাব পাই, বন্ধুত্ব বা প্রেমের বিচ্ছেদের খবর রাখার কোনো দপ্তর নাই। মনের মধ্যে মরে গেলে টের পায় না কেউ। খরার সময় যেমন গাছের শেকড় শুকিয়ে আসে, স্বাভাবিক-গণতান্ত্রিক পরিবেশ না পেলে আত্মা শুকিয়ে আসে।

সংকট আছে বলেই সমাধান দরকার। মানুষ প্রবৃত্তিগতভাবে আশাবাদী। নইলে কোনো কোনো পাখির দলের মতো আমরাও সমষ্টিগতভাবে আত্মহত্যা করতাম। তা করি না কিন্তু ব্যক্তির অপমৃত্যু, ব্যক্তির বিকার, ব্যক্তির আত্মহত্যা ঠেকাতেও পারি না। এ রকম অবস্থায় যখন আশার বাতিঘর আর নাই, তখন নিজের দায়িত্ব নিজের হাতেই তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় কি? বাস্তবতা সহসা বদলাবে না, তাই গেরিলার মতো এই দুঃসহ বাস্তবতার মধ্যে জীবনধারণ ও চলাচলের কৌশল শিখে নিতে হবে। বন্ধু, তোমাকে বলি:

নিজের মধ্যে গুনগুন করে যে সারা দিন কাঁদে, তাকেও আর মায়া হয় না তোমার। নিজেকে ভালোবাসতে ক্লান্ত লাগে, আত্মা যে যত্ন চায় তা দেওয়ার সাধ্য তোমার নাই। জানি কখনো দিন চেপে আসে, রাত চেপে ধরে টুটি। বন্ধুকে ভালো লাগে না, প্রেম ভালো লাগে না। ভালোবেসে মনে হয় ভুল, ভালো না বেসেও মনে হয় ভুল। মনে হয় যা পাওনা তা না-পাওয়াই বোধ হয় নিয়তি। সন্তানের সামনে দাঁড়াতে অপরাধী লাগে। যে জীবনের ঘানি টেনে গেছ, নিজেকে মনে হয় সেই ঘানিতে আটকে পড়া বলদ আর কষ্টের অংশীদার মানুষটিকে মনে হয় ঘানিটানা কলু। ঘানির চাপে যা বের হয়, তা জীবনের রস। সময়ের দেবতা তোমার জীবনের রস চায়, মাঝেমধ্যে রক্তও চায়। জীবনের রস ও রক্ত খেয়ে নিলে পরে, যে ছিবড়া পড়ে থাকে তা রিসাইকেল করে করে তারা উন্নয়ন চালায়।

বন্ধু, জানি জীবনের ঘাটে ঘাটে দেনা ও দায়, পিঠে বেঁধানো বিশ্বাসঘাতকের ছুরি, ভবিষ্যতেও কোনো আশা নেই। বন্ধু, তখনো তুমি বাঁচো। কেননা, তুমি তো জানো না ভবিষ্যতে কী আছে। তুমি তো জানো না আগামীর কোনো দিন এই যন্ত্রণার পুরস্কার হাতে নিয়ে বসে আছে। তুমি তো জানো না, তোমার ভেতরের কোনো শক্তি, কোনো প্রেরণা, কোনো চাপাপড়া গুণ আবার ফুটে বেরুবে। তুমি তো জানো না, তোমারই মতো অন্য কেউ আশার পরপারে তোমারই জন্য চোখ পেতে আছে। বন্ধু, দুঃখ করো, তবুও বাঁচো।

বন্ধু, তুমি বাঁচো। তোমার শরীরে ও মনে তোমার পূর্বমানুষের আশা ও আদরের দান তো এখনো বইছে। তোমার সন্তানের চোখ তোমাকে দেখে এখনো তো উজ্জ্বল হয়। নিজের পুরোনো কাজ ও স্মৃতির মধ্যে খুঁজে কি পাওনা জীবনের কোনো ওম ও উত্তাপ? জগৎ অমানবিক, সমাজ বেদরদী, রাষ্ট্র বেরহম। তাহলেও যে তোমার নয়, তার ওপর অভিমান করে কী লাভ? যারা কষ্ট পাবে তোমাকে হারিয়ে, চলে গিয়ে তাদের মনে শোকের কালো খাদই বা খুঁড়ে যাবে কেন? নিজের পাপে মুষড়ে পড়ে থেকেই বা কী লাভ। জীবন থাকলে হাজারো পুণ্য দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত হবে। কলঙ্কের দাগ রেখে মরে যাওয়ার চাইতে তা ভালো।

জীবনে যদি সান্ত্বনা না থাকে, মরণেও নেই কোনো শুশ্রূষা। বন্ধু, দুঃখ করো কিন্তু বাঁচো। জীবন দুঃখের, এই সত্য যদি জেনেই ফেল, তাহলে দুঃখের মহিমাটুকু ধারণ করো। কান্নায় মন শুদ্ধ হয়, দুঃখের জলে জীবনও শুদ্ধ হয়। সেই দৈব পেলিক্যান পাখির মতো নিজের পাঁজরের রক্ত পান করে হলেও টিকে থাক। যখন গন্তব্য অনিশ্চিত, তখন যাত্রাটা উপভোগ করো। মানুষের মধ্যে, প্রকৃতির ভেতর দিয়ে চলে গেছে আমাদের জীবনের পথ।

এ পথে বাধা আছে কাঁটা আছে; কিন্তু মাঝেমধ্যে শান্তির সরোবর কি মেলে না? হঠাৎ বাঁক পেরিয়ে দিগন্তে সোনালি সূর্যের উদয়কে কি মনে হয় না যে, এ বুঝি প্রথম দিনের সূর্য! হয় এবং তা হতে দেওয়ার জন্য মনটা খোলা রাখা লাগে। পথ চলা চলুক, যা চলে তা ফুরায় না। চলতে থাকলে নতুনের দেখা তুমি পাবেই। যদি আমরা ব্যর্থও হই, তবু তো অস্বীকার করা যাবে না যে, শ্বাস নেওয়ায় সহজ আনন্দ আছে, মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশায় কোনো ক্ষতি নেই। জীবন নিজেই এক প্রতিশ্রুতির সনদ, সনদটা হারিয়ে ফেল না। ব্যর্থ জীবনও একটা আস্ত জীবন। যতক্ষণ জীবন ততক্ষণ সম্ভাবনা, ততক্ষণ নিশ্বাসের অক্সিজেন আর রূপরসগন্ধের আস্বাদ আমাদের জন্য বরাদ্দ। যা আমার তা আমি হেলায় হারাব কেন? হাল ছেড়ো না বন্ধু!

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]