নওয়াজের পক্ষে কলকাঠি নাড়ল কে?

নওয়াজ শরিফ ও তাঁর মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ। রয়টার্স ফাইল ছবি
নওয়াজ শরিফ ও তাঁর মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ। রয়টার্স ফাইল ছবি

পাকিস্তানে গত জুলাইয়ে সাধারণ নির্বাচনের আগে দুর্নীতির দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে। নওয়াজের সমর্থকেরা তো বটেই, দেশটির তুলনামূলক নিরপেক্ষ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও তখন বলেছিলেন, নওয়াজের এই দণ্ডাদেশের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। হাইকোর্টের আদেশে সেই নওয়াজ গত বুধবার জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

২৫ জুলাই জাতীয় নির্বাচন হওয়ার পর নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ শেষে জামিন পেলেন নওয়াজ। এর আগে গত বছরের জুলাই থেকে দেশটির রাজনীতি থেকে নওয়াজকে ছেঁটে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথমে আদালতের আদেশে প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর, নিজের প্রতিষ্ঠিত দলের প্রধানের পদও ছাড়তে হয় তাঁকে। সাধারণ নির্বাচনে তাঁর দলের ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকাতে সব আয়োজন করা হয়। এরপর দুর্নীতির দায়ে দণ্ডাদেশ দিয়ে পাঠানো হয় কারাগারে। এতসব আয়োজন করে কারাগারে পাঠানোর পর অনেকটা প্রত্যাশার বাইরে জামিন পেলেন নওয়াজ। কিন্তু হঠাৎ কী হলো, কে কলকাঠি নাড়ল নওয়াজের পক্ষে?

পাকিস্তানের রাজনীতির সবচেয়ে বড় খেলোয়াড় সেনাবাহিনী টানা দ্বিতীয় মেয়াদে নওয়াজকে ক্ষমতায় দেখতে চায়নি। তাই রাজনীতি থেকে নওয়াজকে একেবারে ছেঁটে ফেলতে আদালতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে তারা। ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের আগে ভোট প্রার্থনার জন্য জনগণের কাছে যাওয়া ঠেকাতে অনেকটা তড়িঘড়ি করে তাঁর বিরুদ্ধে ১০ বছরের সাজা ঘোষণা করা হয়। সাজা দেওয়া হয় তাঁর সম্ভাব্য রাজনৈতিক উত্তরসূরি মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ ও জামাতা মোহাম্মদ সফদারের বিরুদ্ধেও।

ইসলামাবাদ হাইকোর্ট গত বুধবার যে রায় দিয়েছেন, তাতে নওয়াজের বিরুদ্ধে দেশটির অ্যাকাউন্টিবিলিটি আদালতের তড়িঘড়ি করে রায় দেওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। ডন নিউজের খবর থেকে জানা যায়, নওয়াজের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের শুনানির সময় সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতি আতহার মিনাল্লাহ বলেন, নওয়াজ শরিফই যে অ্যাভেনফিল্ড অ্যাপার্টমেন্টের মালিক, তার সপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরতে পারেনি। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ‘বেনিফিট অব ডাউট’ পেতে পারেন। এরপর আদালত নওয়াজ, মরিয়ম ও সফদারের দণ্ডাদেশ স্থগিত করেন। আর হাইকোর্টে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের জামিনে মুক্তির আদেশ দেন।

হাইকোর্টের এই আদেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মুক্তি পান নওয়াজ, মরিয়ম ও সফদার। লক্ষণীয় বিষয় হলো, হাইকোর্টের এই আদেশের পর জামিন স্থগিতের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের ন্যূনতম কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। শুনানির সময়ও জামিনের বিপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের জোরালোভাবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে দেখা যায়নি। এরপর মুক্তির প্রক্রিয়ায় কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতা ধারণার চেয়ে দ্রুততর সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। আবার এই জামিন আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার সুযোগ থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ আপাতত সেদিকে যাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। এই বিষয়গুলোই নওয়াজের পক্ষে কারও কলকাঠি নাড়ার প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করছে।

কারামুক্তির পর গাড়িতে করে যাচ্ছেন নওয়াজ শরিফ। সঙ্গে তাঁর ভাই শাহবাজ শরিফ। ছবি: এএফপি
কারামুক্তির পর গাড়িতে করে যাচ্ছেন নওয়াজ শরিফ। সঙ্গে তাঁর ভাই শাহবাজ শরিফ। ছবি: এএফপি

বিবিসির ইসলামাবাদ প্রতিনিধি ইলিয়াস খান বলছেন, পাকিস্তানের অনেকেই মনে করেন গত জুলাইয়ে সেনাবাহিনীর চাপে নওয়াজকে দণ্ডিত করা হয়। সেনাবাহিনী চায়নি চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান নওয়াজ। এখন নির্বাচন শেষ হয়েছে, নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এখন নওয়াজের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর দিক থেকে কোনো চাপ নেই। তাই জামিন পেয়েছেন নওয়াজ। যদিও কারও কারও মতে, মুক্ত নওয়াজ সেনাবাহিনী তথা পুরো সিস্টেমের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারেন।

এদিকে সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁর প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিয়েছেন সৌদি আরবকে। ইমরান যেদিন সৌদি সফরে গেলেন তাঁর পরদিনই জামিনে মুক্তি পেলেন নওয়াজ। এই সৌদি আরবের সঙ্গে নওয়াজের সুসম্পর্কের কথা অনেকেরই জানা। ক্ষমতায় বসে শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় অর্থভাবে থাকা ইমরান মূলত আর্থিক সহায়তার পেতেই প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নিয়েছেন। ইমরান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পরই যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে আইএমএফের সহায়তা প্যাকেজ বন্ধ হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েন তিনি। এই মুহূর্তে প্রকৃত অর্থেই সৌদি ছাড়া কারও সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রীর। সৌদি নেতৃত্ব অবশ্য পাকিস্তানকে ইসলামি আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ার ইমরানের ধারণার প্রশংসা করেছে। সঙ্গে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছে। এর বিনিময়ে দীর্ঘদিনের ‘বন্ধু’ নওয়াজের মুক্তির কলকাঠিটাও সৌদি নেতৃত্বই নেড়েছে কি না কে জানে!

নওয়াজের এমন মুক্তি অবশ্য নতুন নয়। সাবেক সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফের অভ্যুত্থানে ১৯৯৯ সালে ক্ষমতা হারিয়েছিলেন তিনি। ২০০০ সালে সন্ত্রাস-দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। তবে পরে ক্ষমতাসীন মোশাররফের সঙ্গে বোঝাপড়া সাপেক্ষে স্বেচ্ছা নির্বাসনে সৌদি আরব যান নওয়াজ। বলা হয়ে থাকে, ওই সময়ও নওয়াজের জন্য মধ্যস্থতা করেছিল সৌদি নেতৃত্ব। পরে ২০০৭ সালে দেশে ফিরে নির্বাচন করে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হন তিনি। এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন নওয়াজ। পাকিস্তানের ইতিহাস বলে, তাতে সায় ছিল সামরিক বাহিনীর।

তবে এবারের বিষয়টি যেন কিছুটা ভিন্ন। নওয়াজকে ছুড়ে ফেলা সেনাবাহিনী এখন তাদের পছন্দসই প্রধানমন্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছে। তাই এবার ‘কলকাঠির নাড়ায়’ নওয়াজের মুক্তি মিললেও রাজনীতির মাঠের সেই শক্তিশালী নওয়াজের প্রত্যাবর্তন ঘটবে কিনা, তা বলা সত্যিই কঠিন। তবে দেশটি পাকিস্তান বলে সবকিছুই সম্ভব!

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]