জঙ্গি দমনে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন

দণ্ডিত তিন জঙ্গিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা। এটি কি নিছক দুর্ঘটনা, না জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি? পড়ুন নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মন্তব্য

দণ্ডিত তিন জঙ্গিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়
দণ্ডিত তিন জঙ্গিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়

গত পাঁচ বছরে জেএমবি, হুজিসহ বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপের সদস্যদের পাকড়াও করার ক্ষেত্রে সরকার বেশ সক্রিয় ছিল এবং এখনো আছে। তবে এ-ও বুঝতে হবে যে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের ক্ষেত্রে এটি হলো একটি উপায়, একমাত্র নয়। আমরা যে কথাটির ওপর জোর দিই তা হলো, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করতে হলে এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামাজিক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তাতে দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে একত্র করা জরুরি।
সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে, এটি অবশ্যই ভালো দিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, এর সঙ্গে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেই; বরং দোষারোপের রাজনীতি চলছে। সম্প্রতি পুলিশের গাড়ি থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের যে ঘটনা ঘটল, তা নিয়েও অভিযোগের তির ছুড়ছে একে অপরের বিরুদ্ধে। এর অর্থ, জঙ্গিবাদের বিষয়টি কেউ-ই গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না। এ থেকে দলীয় ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাচ্ছে উভয় পক্ষ।
আমাদের সমাজটি মারাত্মকভাবে বিভাজিত। রাজনৈতিকভাবে যেমন, তেমনি মতাদর্শিকভাবেও। যেসব গোষ্ঠী বা সংগঠন ধর্ম নিয়ে কাজ করে, তাদের মধ্যে একধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে। এর কারণ যা-ই হোক, রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সেই বিচ্ছিন্নতা বাড়তে না দেওয়া এবং তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা। কেননা, সামাজিক সংঘবদ্ধতাই রাষ্ট্রের নিরাপত্তার পূর্বশর্ত। এর অর্থ এই নয় যে যারা সন্ত্রাস করছে বা জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ, সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না।
দণ্ডিত তিন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রমাণিত হলো যে জঙ্গিবাদীরা যতটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে, ততটা নিষ্ক্রিয় তারা হয়নি। এই মুহূর্তে তারা প্রকাশ্য তৎপরতা চালাচ্ছে না, বলা যায়, স্লিপিং সেল বা ঘুমন্ত অবস্থায় আছে। যেকোনো সময় বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে।
আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে রাজনৈতিক হানাহানির সুযোগেই জঙ্গিগোষ্ঠী সমাজে জায়গা করে নেয়। গত দুই বছরের অব্যাহত রাজনৈতিক হানাহানির কারণে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ ব্যস্ত ছিল বিরোধী দলের আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে। এমনকি নিম্ন আদালতও ব্যস্ত ছিলেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের জামিন শুনানির কাজে। ফলে জঙ্গিদের তৎপরতা রোধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যতটা মনোযোগ দেওয়ার কথা, সেটি তাঁরা দিতে পারেননি। ফলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান অনেকটা বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোতে পরিণত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।
কেবল সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে যে এ ধরনের জঙ্গিগোষ্ঠীকে নির্মূল করা যায় না, তার প্রমাণ আফগানিস্তান। ১২ বছর ধরে পরাশক্তিগুলো সেখানে সামরিক অভিযান চালিয়েও আল-কায়েদাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
আরেকটি কথা, বাংলাদেশের ৮৯-৯০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাদের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতির প্রতিও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। অনেকেই রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতিতে অহেতুক ধর্মকে টেনে আনেন, ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করতেও দ্বিধা করেন না। এসব বক্তৃতা-বিবৃতিতে যে ধর্মপ্রাণ মানুষ আহত হতে পারেন, তা-ও মনে রাখেন না। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ হলেও ধর্মান্ধ নন। তবে ধর্মপ্রাণ মানুষ আহত হন এমন কিছু করলে জঙ্গিবাদীরা সেই সুযোগ নিতে পারে। অন্যদিকে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজনটি অনেক বেশি প্রকট। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এই বৈষম্য দূর করতে হবে, শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে।
আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক আছে। জাতীয় ইস্যুগুলোর ব্যাপারেও তাদের মধ্যে কোনো মতৈক্য নেই। যেকোনো দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা বড় হুমকি বলে মনে করি।
আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও এর রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। এত বড় সমাজে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জঙ্গি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য রাজনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
আশার কথা, বাংলাদেশে জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পকেটে তৎপরতা চালালেও বৃহত্তর সমাজে শিকড় গাড়তে পারেনি। এর অন্যতম কারণ, এখানকার মানুষের সহিষ্ণু মনোভাব ও নারীর ক্ষমতায়ন। তৈরি পোশাকশিল্পে ৪০-৪৫ লাখ নারী কাজ করেন। তাঁরা কোনোভাবেই এসব জঙ্গি তৎপরতা মেনে নেবেন না।
সর্বোপরি জঙ্গিবাদ নির্মূলে চাই রাজনৈতিক ঐকমত্য। বিরোধী দলের সঙ্গে যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, এ ব্যাপারে সরকারের উচিত হবে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সেটাই করা হয়ে থাকে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার।
[email protected]