সংবাদপত্র, ইন্টারনেট না সরকার?

‘সকালে এক কাপ চা ও একটি পত্রিকা যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। টেলিভিশন বন্ধ রেখে সকালে পত্রিকা নিয়ে বসি। সব পত্রিকা যে পক্ষে লেখে, তা নয়। প্রয়োজনীয় সংবাদগুলো মার্ক করি। সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে বলি। সংবাদপত্র থেকে অনেক তথ্য পাই। দুর্গম জায়গার অনেক তথ্যও সংবাদপত্রে আসে। তাতে আমরা সহযোগিতা পাই। এ জন্য সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’

এই কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট হতে অসুস্থ, অসচ্ছল ও দুর্ঘটনাজনিত আহত ও নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের অনুকূলে আর্থিক অনুদানের চেক বিতরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। আমি নিজে কাজ করি সংবাদপত্রে। ফলে প্রধানমন্ত্রী টেলিভিশন বন্ধ রেখে সংবাদপত্র পাঠ করে তাঁর সকাল শুরু করেন শুনে আমি মনে মনে খুশি। জানি না টেলিভিশনে কর্মরত আমাদের বন্ধুরা এই কথায় খুশি হবেন নাকি বেজার হবেন।

এই কলামের নিয়মিত পাঠকেরা জানেন, আমিও সকালবেলা এক কাপ চা নিয়েই খবরের কাগজ পড়তে বসতাম। কিন্তু আমার একটা সমস্যা দেখা দিল। আমি খবরের কাগজ ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। আমার কি মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা দেখা দিল? আমার কি চোখ খারাপ হচ্ছে? পরে বুঝলাম, চায়ের কাপ থেকে ভাপ ওঠে। চশমার কাচ ঘোলা হয়ে যায়। এ জন্য এখন চা খেতে খেতে আর খবরের কাগজ পড়া হয়ে ওঠে না।

টেলিভিশন আর খবরের কাগজের সুবিধা–অসুবিধার কতগুলো তুলনা এই সুযোগে করা যেতে পারে। টেলিভিশন পড়তে হয় না। আপনি ট্রেডমিলে উঠে হাঁটতে হাঁটতে টিভি দেখতে পারবেন।

তবে এ ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছ থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। যুবা বয়সে রুজভেল্ট একবার নৌকাচোরদের ধাওয়া করে ধরে ফেলেছিলেন। তাদের নিয়ে ফেরার পথে সবকিছু তুষারে পরিণত হয়। আট দিন ধরে তাঁরা পথ অতিক্রম করেন। চোরদের ওপরে তাঁকে নজর রাখতে হয়। ৪০ ঘণ্টা তিনি ঘুমাননি। ওই সময় তিনি আন্না কারেনিনা জোরে জোরে পড়তেন। চোরদেরও আন্না কারেনিনা পড়ে তিনি শুনিয়েছিলেন। বইটা তিনি ওই দুর্গম বিপদসংকুল তুষারকবলিত নৌযাত্রাতেই পড়ে শেষ করেছিলেন।

সংবাদপত্রের সুবিধা হলো, এটা টেবিলে ভাঁজ করে রাখা যায়। এটা দিয়ে বাতাস করা যায়, হাত মোছা যায়, আবার মুখ ঢেকেও ফেলা যায়। এই কৌতুকটা আমি আগে অনেকবার শুনিয়েছি।

একবার একটা বাঘ সুন্দরবনে ঘুমিয়ে পড়েছিল। একটা বাঁদর ঘুমন্ত বাঘের গায়ে বসে তার কান দুটো আচ্ছা করে মলে দিচ্ছিল। এই জন্য বাঘেদের কখনো ঘুমিয়ে পড়তে নেই। বাঘের ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখল, গায়ের ওপরে একটা বাঁদর, তার কানে বাঁদরের দুই হাত, আর চারদিকের পশুপাখিরা হাসাহাসি করছে।

বাঘ যেই উঠে বসল, অমনি বাঁদর লাফিয়ে নেমে পালাতে লাগল। বাঁদর দৌড়াচ্ছে। বাঘও দৌড়াচ্ছে পিছু পিছু। বাঁদর একটা লোকালয়ে ঢুকে পড়ল। বাঘও পেছনে পেছনে ছুটে গেল লোকালয়ে।

বাঁদর একটা সরকারি অফিসে ঢুকে গেল। বাঘও তাকে অনুসরণ করল। বাঁদর একটা বড় সাহেবের ঘরে গিয়ে দেখে একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল। একটা কোট চেয়ারে ঝোলানো। সামনে একটা খবরের কাগজ। বাঁদর চেয়ারে বসে কোট গায়ে দিয়ে পেপার দিয়ে মুখটা আড়াল করে চেয়ারে বসে পড়ল।

বাঘ এসে গেল পরের মুহূর্তেই। বলল, ‘স্যার, আপনি কি এইখানে একটা বাঁদরকে ঢুকতে দেখেছেন?’

বাঁদর গলার স্বর মোটা করে বলল, ‘কোন বাঁদরটা? যে বাঁদরটা একটা বাঘের দুই কান মলে দিয়েছে? বনের পশুপাখি খুব হাসাহাসি করেছে?’

বাঘ বলল, ‘সর্বনাশ। আপনি জানলেন কী করে? এই খবর কি সংবাদপত্রে ছাপা হয়ে গেছে?’ বাঘ দৌড়ে আবার বনে ফিরে গেল।

খবরের কাগজ দিয়ে রোদ্দুরে মুখ রক্ষা করা যায়, বৃষ্টির সময় খবরের কাগজ মাথায় ছাতা হিসেবেও ব্যবহার করা যায়।

যাই হোক, খবরের কাগজের ও টেলিভিশনের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী এসে গেছে। তা হলো ইন্টারনেট। সকাল আটটার আগে কাগজ আসবে না বাসায়। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নেটে খবরগুলো সহজেই দেখে নেওয়া যায়। এমনকি রাতে শোয়ার আগেও খবর দেখে নেওয়া যায়।

তো দেশে নতুন আইন পাস হয়েছে। মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘এই আইনটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক আইন। আমরা একটি ঐতিহাসিক কাজের সাক্ষী হয়ে সংসদে থাকছি।’

আমরাও ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকলাম। আমাদের নাতি-নাতনিরা বলতে পারবে, ‘ওই আইন যখন পাস হয়, তখন তো তোমরা ছিলা।’ আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমাদের নকল দাঁত খুলে টেবিলে রাখব, আর বলব, ‘হ্যাঁ দাদু, তা তো ছিলামই।’

আমেরিকায় একটা আইন আছে, সানশাইন ল। সূর্যালোক আইন। সরকারি তথ্য গোপন করা যাবে না। যেকোনো নাগরিক সরকারি অফিসের ফাইল দেখতে চাইলে কর্মকর্তা তা দেখাতে বাধ্য। দেশের মালিক তো নাগরিকেরা। তার মানে এই না যে অ্যাটম বোমার সুইচ কোথায় আছে, বা সেটার পাসওয়ার্ড প্রকাশ করে দেওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন, তোমার গোপন কথাটি সখী রেখো না মনে। কিছু কথা গোপন রাখতেই হয়।

একটা তোতাপাখি প্লেনে উঠেছে। সে বিমানসেবকদের সঙ্গে খুব খারাপ ভাষায় কথা বলতে লাগল। এই বদমাশ, চা দে। এই কুলাঙ্গার, খাবার দে।

তখন বিমানসেবকেরা তাকে তাড়াতাড়ি করে চা-টা এনে দিতে লাগল। তার দেখাদেখি একজন মানুষও একইভাবে গালিগালাজ করে অর্ডার দিতে আরম্ভ করল।

তখন দুজনকেই বিমানের দরজা খুলে আকাশ থেকে ফেলে দেওয়া হলো।

তোতাপাখিটা উড়তে উড়তে পাশের মানবযাত্রীকে বলল, তুমি যদি উড়তে না জানো, তাহলে তোমার জানা উচিত, কোথায় কাকে কী বলতে হবে।

আমার এই লেখাটা অনলাইনে প্রকাশিত হবে। কাজেই আমি এখানেই থামছি। শুধু একটা কথা বলে যাই...

১৭৮৭ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জেফারসন বলেছেন, একটা দেশে সরকার আছে সংবাদপত্র নাই, আরেকটা দেশে সংবাদপত্র আছে সরকার নাই, দুটোর একটা বেছে নিতে হলে আমি সরকারবিহীন সংবাদপত্রই বেছে নেব।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক