শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি

আগামী সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দামামার মধ্যে সারা দেশের নন এমপিও ৪৭০৬টি স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির (মান্থলি পে-অর্ডার, যার আওতায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের সরকারি অনুদান পেয়ে থাকেন) প্রক্রিয়ায় বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন প্রত্যাশিত। বেসরকারি শিক্ষকদের আবেগতাড়িত আন্দোলনের সঙ্গে এখন যে নির্বাচনী আবেগ ও বিবেচনা যুক্ত হতে পারে তাতে সন্দেহের অবকাশ কম। বিশেষ করে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ২০১০ সালে বর্তমান সরকার ১৬২৪টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেছিল। কিন্তু তখন শিক্ষার মান উন্নয়ন সংক্রান্ত শর্তাবলি যথাযথ প্রাধান্য দেওয়া হয়নি বলেই বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ উঠেছিল। আমাদের আশা ছিল আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকার বা তার আগের আমলের ভুলগুলো শোধরাতে নজর দেবে। ২০০৬ সালে শিক্ষার মান ও আর্থিক অনুদানসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের সরকারি কমিটির প্রতিবেদন থেকে আমরা জানি যে ২০০৬ সালের আগের এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর গুণমান যথেষ্ট সন্তোষজনক ছিল না। কিন্তু সেই ভুল সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০১০ সালে ১৬২৪টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির পর ৮ বছরের ব্যবধানে আবারও এমপিওভুক্তির প্রাক-নির্বাচনী একটি তোড়জোড় আমরা সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করছি।

স্মরণযোগ্য যে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্যদের সুপারিশকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়ার একটি বিপজ্জনক প্রবণতা আমরা এর আগে সরকারের মধ্যে প্রকাশ পেতে দেখেছি। যেমন ২০১০ সালের পর একবার প্রত্যেক উপজেলায় ৩টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করতে সাংসদদের কাছ থেকে সুপারিশ নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরকারকে ধন্যবাদ যে সেই উদ্যোগ সমালোচনার মুখে স্থগিত করা হয়েছিল। এখন নির্বাচন সামনে রেখে সেই পথে নীতিনির্ধারকেরা যাতে একেবারেই না হাঁটেন, সেটা অবশ্যই আমরা আশা করব।

আমরা অবশ্যই অধিকসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির উদ্যোগকে নীতিগতভাবে স্বাগত জানাই। কিন্তু এ বিষয়ে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী এম এ মুহিত যে সতর্কতা অনুসরণে হুঁশিয়ার করেছিলেন, তা যে সত্যিই আমলে নেওয়া হয়েছে সেই বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ হতে চাই।

বর্তমানে দেশের ২৭০০০ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী সরকারি আর্থিক অনুদানপ্রাপ্ত বা এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখেন, সেখানে ১০ জন শিক্ষক রয়েছেন। কিন্তু স্কুলটির একটিমাত্র শ্রেণি কক্ষে সব শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এ রকম অবস্থা যেসব প্রতিষ্ঠানের রয়েছে, তারা শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় আবারও অন্যায্য সুবিধা যাতে না পায়, সেদিকে নজর রাখাটা জরুরি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষকদের প্রবল আন্দোলন ও আমরণ অনশন সত্ত্বেও অর্থ মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে অর্থ না বরাদ্দে অনড় ছিল। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী সংসদে ১৬ সেপ্টেম্বর জানিয়েছেন যে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজি হয়েছে তবে কত অর্থ তারা দেবে, তা নিশ্চিত হয়নি। এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়ায় সবার আগে শিক্ষার মান বিচার্য। এর সঙ্গে ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসংখ্যার অনুপাতের সমন্বয় ঘটাতে হবে। কোনো কোনো জেলা বা উপজেলায় বিপুলসংখ্যক আবার কোথাও যথেষ্ট নগণ্য, এ রকম বৈষম্যমূলক অবস্থা বজায় রাখা কাম্য নয়।

গত ডিসেম্বরে কয়েক শ শিক্ষকের আমরণ অনশনের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ জুলাই সংসদে শিক্ষার মান উন্নয়ন বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সার্বিক বিচারে শিক্ষার মান যে উন্নত হয়নি, তা নতুন করে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে নতুন এমপিওভুক্তির প্রস্তুতিপর্বে সরকার বা শিক্ষক কারওরই বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।