বধ্যভূমির নাম পিলখানা

কবরে স্বজনহারার নির্বাক হাহাকার
কবরে স্বজনহারার নির্বাক হাহাকার

এখনো ফেব্রুয়ারির দিনগুলো শেষ হয়ে যায়নি। ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস। চেতনার মাস। ফেব্রুয়ারি শোকের মাসও। সংগ্রামী বাঙালি শোককে শক্তিতে পরিণত করেছিল। মাথানত করেনি, পরাজয় বরণ করেনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় ‘বল বীর— বল উন্নত মম শির। শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।’ এটাই একুশের চেতনা। নোবেলজয়ী আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর কালোত্তীর্ণ বই ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি-তে লিখেছেন যে মানুষকে ধ্বংস করা যায়কিন্তু পরাস্ত করা যায়না। এ অদম্য স্পৃহা আর বিশ্বাসই একুশের চেতনা।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে একুশের মাস ফেব্রুয়ারিতেই এক মহা কলঙ্কময় ঘটনা সংঘটিত হয়। ঘটানো হয় এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড, এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ। বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় খুন হন টগবগে চৌকস সেনাবাহিনীর দক্ষ ৫৭ জন অফিসার। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে এ হত্যাযজ্ঞ চলে এক পৈশাচিক উন্মাদনায়। মেজর জেনারেল থেকে নিম্নে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত সব র‌্যাংকের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয় পিলখানার বধ্যভূমিতে। হত্যার শিকার হন মহাপরিচালক, পরিচালকেরা, ব্যাটালিয়ন কমান্ডাররা ও অধিনায়কেরা। তাঁদের স্ত্রী-কন্যারাও রক্ষা পাননি, চরমভাবে সবাই লাঞ্ছিত হন, নৃশংসভাবে খুন হন। বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানা পরিণত হয় এক মৃত্যু উপত্যকায়। এখান থেকে বেরিয়ে আসে লাশের পর লাশের বিরামহীন কফিনের মিছিল। পিলখানা দীর্ঘদিন ধরে পরিণত থাকে এক ভীতিকর সুনসান বিরানভূমি হয়ে।
২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ এই মহানারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রতিটি স্তরের ঘটনার ধারাবাহিকতা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। প্রয়োজন ঘটনার অতি গভীরে সূক্ষ্ম তদন্ত। ঘটনা-পূর্ব, ঘটনাকাল ও ঘটনা-পরবর্তী প্রতিটি বিষয় গভীর অনুসন্ধিৎসু চোখের বিশ্লেষণে সত্য উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন কার্যকারণের বিস্তারিত সুদূরপ্রসারী পর্যালোচনা। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে বিডিআর হত্যাকাণ্ড কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়। নয় বিডিআর সদস্যদের সাধারণ অসন্তোষ ও অভিযোগের ফল, কিংবা নিছক ডাল-ভাত কর্মসূচির হিসাবের গরমিলের বিস্ফোরণও নয়। অনেকেই বিশ্বাস করে এর নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। দেশের ও বাইরের অপশক্তির যোগসাজশের কথাও বলেছে অনেকে। বাংলাদেশের মানুষ জাতির এ মহা কলঙ্কময় ঘটনার নেপথ্যের খলনায়কদের মুখোশ উন্মোচন দেখতে চায়, পরিকল্পনাকারীদের দৃশ্যপটে হাজির দেখতে চায়, বিচারের কাঠগড়ায় দেখতে চায়।
আমরা যুদ্ধাপরাধসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছি। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছি। কর্মরত ও দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যা, তাঁদের স্ত্রী ও কন্যাদের চরম লাঞ্ছনা নিশ্চয়ই মানবতাবিরোধী বড় অপরাধ। আমি সেই আলোকেই এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায় ও যথাযথ বিচারের দাবি জানিয়ে এসেছি। দাবি জানিয়ে এসেছি মূল পরিকল্পনাকারীদের কাঠগড়ায় উপস্থিতির বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তির। এরা যারাই হোক না কেন, যত বড় শক্তিধর মহাপরাক্রান্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীই হোক না কেন। তাদের একমাত্র পরিচয় তারা জাতির শত্রু, তারা চরম সন্ত্রাসী, তাদের অপরাধ অমার্জনীয়। জাতি কখনোই আমাদের কাপুরুষোচিত এ ব্যর্থতা ক্ষমা করবে না। প্রজন্মের কাছে আমরা দায়ী থাকব। যারা নেপথ্যে অধরা আছে, আছে দৃশ্যহীন, লোকচক্ষুর অন্তরালে, নিরাপদ অভয়ারণ্যে, তাদের বিচারের জন্য জাতি অধীর হয়ে অপেক্ষা করবে। কিন্তু বিচার আজ বা কাল হতেই হবে।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল চরম বর্বরোচিত। ইতিহাসে এমন নজির পাওয়া কঠিন। চেঙ্গিস, হালাকু খানের নির্মমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য হতে পারে বাংলাদেশের বীরোচিত সেনাবাহিনীকে পঙ্গু করা, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিডিআরের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যকে মুছে দেওয়া। আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে দুর্বল করা। সীমান্তকে বিপজ্জনকভাবে অরক্ষিত করা, জাতিকে অস্থিতিশীল করা।
বিডিআর এক মহান গৌরবোজ্জ্বল বীর বাহিনী। তার আছে ২০০ বছরেরও দীর্ঘ বীরোচিত ঐতিহ্য। আছে সমৃদ্ধ পেশা-দক্ষতার ইতিহাস। এ বাহিনীর দু-দুজন সৈনিক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠের অধিকারী। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ বাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে একসঙ্গে মিলিয়ে দেশকে বিনির্মাণ করেছে। সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী এ বাহিনী দেশমাতৃকার এক ইঞ্চি ভূমিও কখনো কাউকে দখলে নিতে দেয়নি। নিশ্চিত করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে শান্তি, নিশ্চিত করেছে জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা। আমি গর্বিত এ বাহিনীতে আমার বছর তিনেক নিয়োজিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। ডাইরেক্টর অপারেশন অ্যান্ড ট্রেনিং হিসেবে আমি দেখেছি তাদের পেশাগত দক্ষতা, গভীর দেশপ্রেম, শৃঙ্খলাবোধ এবং নিষ্ঠা। আজ বিডিআর নামটাও মুছে গেছে। এ শুধু অতীত ইতিহাস মাত্র পৃষ্ঠায় লেখা। আমি কষ্ট পাই। বিজিবি সুসংগঠিত হোক কামনা করি। বিডিআরের ঐতিহ্য তারা বহন করুক, সাহসী, সমৃদ্ধশালী ও গর্বিত হোক, বহন করুক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ ও বীরশ্রেষ্ঠ আবদুর রউফের মহান উত্তরাধিকার।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হত্যার মরণখেলা দেখেছি। এক অশুভ চক্র আমাদের বারবার আঘাত হেনেছে, দেখেছি। দেখেছি মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যা। বঙ্গবন্ধু। তিনিই সেই মহান পুরুষ, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনসত্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন, বিকশিত করেছিলেন। বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। লক্ষ-নিযুত মানুষের জনসমুদ্রে গভীর আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাদের এই সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমরা দেখেছি মহান রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের নিষ্ঠুর হত্যা। একাত্তরের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া তাঁর ঘোষণার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন। সেই স্ফুলিঙ্গই মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। সমগ্র বাংলার প্রান্তরজুড়ে আগুনের লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয়। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের এই পূতপবিত্র পুণ্যভূমিতে ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ, রক্তপাত আর হত্যা। আমরা মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম বীরদের নির্মম নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছি। বীর উত্তম বীর জেনারেল খালেদ মোশারফ, জেনারেল মঞ্জুরসহ অনেক সেক্টর কমান্ডারের মৃত্যু দেখেছি। আমরা দেখেছি জাতীয় মহান চার নেতার জেল হত্যাকাণ্ড। এগুলোর সবই জাতির কপালে বড় বড় কঙ্কক তিলক। এমন ঘটনা বারবার কেন ঘটে চলেছে? কারা আমাদের মহান জাতীয় বীরদের বারবার হত্যা করেছে? কারা বারবার রক্তপাত ঘটিয়েছে? কেন বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার এমন রক্তপাতের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে?
বিডিআরের পিলখানা হত্যাকাণ্ড আমার কাছে মনে হয়েছে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে হয়েছে সবই কেমন যেন একই সূত্রে গাঁথা। সবই এক অদৃশ্য ধারাবাহিকতা। আর সবই কেমন যেন এক অদ্ভুতুড়ে অনুদ্ঘাটিত রহস্যপূর্ণ গা-ছমছম করা গোয়েন্দা কাহিনির অংশ। আমরা এর চিরদিনের যবনিকা টানতে চাই। আমরা আর রক্তপাত চাই না। ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন হোক। সংঘাত আর রক্তপাতের এই ধারা এখানেই শেষ হোক। সকল হিংসা-বিদ্বেষ ষড়যন্ত্র আর উন্মত্ততার সমাধি হোক। শান্তি, সমপ্রীতি ও সমৃদ্ধির এক শক্তিশালী উন্নত নতুন বাংলাদেশের উত্থান হোক।

লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান।