ছাত্রলীগে কত ধারা?

ছাত্রলীগের একজন সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রায়ই অভিযোগ করতেন যে তাঁরা অনেক ভালো কাজ করলেও গণমাধ্যম প্রচার করে না। কিন্তু ছাত্রলীগের কোনো নেতা-কর্মী তিলমাত্র ভুল করলে সেটি তাল আকারে প্রচার করে। এরপর মনস্থির করেছি, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ভালো কাজের প্রশংসা করব। ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হওয়ার পর আশা করা গিয়েছিল, নেতা-কর্মীরা অতীতের গ্লানি-ক্লেদ ভুলে নব উদ্যমে শিক্ষাঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন। 

এরপর পত্রিকায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছাত্রদলের সভাপতিকে উষ্ণ আলিঙ্গন করে ক্যাম্পাসে স্বাগত জানানোর ছবিও ছাপা হলো। গত ১০ বছরে ক্যাম্পাসে ‘ছাত্রলীগ শাসনের’ এক বিরল ঘটনাই বটে। বিএনপি শাসনামলে ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী লীগ শাসনামলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাস ছাড়ার দৃশ্যই দেখে আসছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেখানে ছাত্রদলের নেতাকে ছাত্রলীগের নেতার আলিঙ্গনাবদ্ধ ছবি আমাদের আনন্দিত না করে পারে না। উপলক্ষ ছিল ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামানের পরামর্শ সভা। এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকদেখানো আয়োজন হলেও তাদের ধন্যবাদ জানাই এ রকম একটি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য।

কিন্তু এরপরই আরেকটি বিপরীতমুখী ছবি দেখলাম। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি যেদিন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সুপারিশ করল, সেদিন সাধারণ ছাত্র পরিষদ তাকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল-সমাবেশ করেছিল। তারা দ্রুত সুপারিশ বাস্তবায়নেরও দাবি জানায়। কিন্তু যেখানে তাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল সেখানেই ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে আনন্দ সমাবেশ ডাকে। দুই পক্ষ পাশাপাশি মিছিল করলেও কোনো সংঘাত হয়নি। কোটা সংস্কারের দাবিতে যখন সাধারণ ছাত্র পরিষদ আন্দোলন করেছিল, তখন ছাত্রলীগের ভূমিকা কী ছিল সেটাও ভুলে যাইনি। আমরা দেখেছি, বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের মারধর করেছেন। হাতুড়ি থেরাপি দিয়ে কারও পা ভেঙে দিয়েছেন। নারী শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করেছেন। ছাত্রলীগের বিজয়োল্লাস করার আগে উচিত ছিল নিগৃহীত শিক্ষার্থীর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া।

ছাত্রলীগের পুরোনো কমিটি সারা দেশে ছাত্রলীগের গৃহবিবাদ বন্ধ করতে পারেনি। গত ১০ বছরে বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বহু শিক্ষার্থী মারা গেছেন। দেশবাসী আশা করেছিল, জাতীয় নির্বাচনের আগে গঠিত ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব ছাত্রলীগের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে। কিন্তু চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের কমটি গঠন নিয়ে যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হলো, নেতা-কর্মীরা অস্ত্রের মহড়া দিলেন, তাতে শান্তির আশা সুদূর পরাহত বলেই মনে করি। সাব্বির সাদেক নামে ছাত্রলীগের এক নেতা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছেন, যেই ছবি সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক এবং বর্তমান সিটির মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

গত সোমবার দিবাগত রাতে ২৫ সদস্যের চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করে সংগঠনের নগর কমিটি। এতে প্রয়াত নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী মাহমুদুল করিমকে সভাপতি এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামের অনুসারী সুভাষ মল্লিককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে কমিটি বাতিলের দাবিতে মাঠে নামেন নাছির উদ্দীনের পক্ষের নেতা-কর্মীরা। প্রথম দিন তাঁরা পৌনে তিন ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন। বুধবার তাঁদের মিছিল থেকে ফাঁকা গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে।

যোগাযোগ করা হলে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীরা তাঁর অনুসারী নয়। একই সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে বলেন, নগর আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে আলোচনা না করে, কোনো সম্মেলন না করে হঠাৎ কমিটি গঠন ইতিবাচক নয়। তাঁর প্রশ্ন, কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিরা কীভাবে স্থান পেলেন?

এর আগে ২০১৭ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সময় সেলিম নামের যুবলীগ নামধারী এক সন্ত্রাসী অস্ত্র উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছোড়েন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁর ছবি প্রকাশ হলেও পুলিশ তাঁর খোঁজ পায়নি। একই বছরের ৬ অক্টোবর নগর ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে তাঁর নালাপাড়ার বাসায় গিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি উদ্ধার হয়নি এখনো।

এদিকে সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রাম কলেজে সদ্যঘোষিত ছাত্রলীগের কমিটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছয়জন। কমিটিতে তাঁরা বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। কমিটি বাতিল চাওয়া প্রসঙ্গে নগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর প্রথম আলোকে বলেন, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনই শিবিরবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। সবদিক বিবেচনা করেই তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যাঁরা এখন কমিটি বাতিল চান, তাঁরা সংগঠনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
এই ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিরোধ শুধু ছাত্রলীগেই সীমিত নয়। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে যে তিন ধারা আছে, এ বিরোধ তারই ফল। চট্টগ্রাম ছাত্রলীগে মহিউদ্দিন ও নাছির উদ্দীন অনুসারীরা বরাবরই দুই গ্রুপে বিভক্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নুরুল ইসলাম বিএসসির অনুসারীদের আরেকটি গ্রুপ।

কোনো রাজনৈতিক দল যদি নীতি ও আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে সেখানে ব্যক্তি বা নেতাকেন্দ্রিক গ্রুপিং হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের প্রায় রাজনৈতিক দলেই নেতৃত্বের কোন্দল ও গ্রুপিং আছে। এবং নেতারা নিজেদের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব সুরক্ষা করতে ছাত্র ও যুবকদের ব্যবহার করে থাকেন। চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নেওয়া হয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মেয়র নাছির উদ্দীন।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে সব সময় দাবি করা হয়, ছাত্রলীগে কোনো গ্রুপিং নেই। কিন্তু বাস্তবে ঠিক তার উল্টো। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব বহাল রাখতে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে ব্যবহার করেন। এর ফলে আওয়ামী লীগের বিরোধ ছাত্রলীগে সংক্রমিত হয়। চট্টগ্রামে গ্রুপিংয়ের উত্তাপটা একটু বেশি বলেই মনে হয়।

সর্বশেষ খবর হলো, ছাত্রলীগের অস্ত্র উঁচিয়ে ধরা নেতাকে চট্টগ্রাম পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এভাবে আইন যদি সবার প্রতি সমভাবে প্রয়োগ হয়, ছাত্রলীগে অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম্য যেমন কমবে, শিক্ষাঙ্গনেও শান্তি ফিরে আসবে।