তিতাসে দুর্নীতির মহোৎসব

গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় তিতাসে ‘কেজি মেপে’ ঘুষ লেনদেন শিরোনামে যে খবর ছাপা হয়েছে, তাতে সরকারি সেবা খাতের উৎকোচ-দুর্নীতির মহোৎসবের সামান্য চিত্রই উঠে এসেছে। প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও সরকারি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অনেক কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অসাধু মালিক পরস্পরের যোগসাজশে রাষ্ট্র তথা জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান হলো তিতাস কোম্পানি। ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫৬ কিলোমিটার পাইপলাইন থাকা কোম্পানিটির মোট শিল্পগ্রাহক ৪ হাজার ৬১০। তবে ঘুষ নিতে প্রধানত ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুর অঞ্চলের শিল্পকারখানার মালিকদের বেছে নিয়েছে চক্রটি। তিতাসের গ্যাস-সংযোগ পাওয়া বেশির ভাগ কারখানা গাজীপুর অঞ্চলেই।

টেলিফোনে বা খুদে বার্তায় ঘুষের অর্থের পরিমাণ ও ঘুষ লেনদেনের বিষয়টি যাতে ফাঁস না হয়ে যায়, সে জন্য তাঁরা সাংকেতিক ভাষা ‘কেজি’ ব্যবহার করেছেন। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গাজীপুর, সাভার, ভালুকা ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে ঘুষ খাওয়ার জন্য তিতাসের কর্মকর্তারা একে অপরের সঙ্গে এই সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করেন। ঘুষ আদান-প্রদানকারীর মধ্যে একটি দালাল চক্র গড়ে উঠেছে, যারা অর্থ প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেয়। তিতাসের দুর্নীতি এতটাই প্রকট যে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) গত ২৩ এপ্রিলের সভায় সংস্থাটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। কেননা, সব ব্যবসায়ী তো তিতাসের গোপন লেনদেনে যুক্ত হননি।

এর আগে পেট্রোবাংলার এক অনুসন্ধানে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ৭৫ কোটি টাকার বেশি গ্যাস নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। পেট্রোবাংলা ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের তাগিদ দিলেও এখনো পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। যেখানে সবাই না হলেও অধিকাংশ চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, সেখানে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, তা আশা করা যায় না।

প্রথম আলোয় খবর প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ আট কর্মকর্তাকে তলব করেছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব বলেছেন, ‘তিতাসের চোরেরা সব সময়ই চুরি করে। হাতেনাতে ধরা না পড়ায় আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি না।’ তিতাসে চুরি হয়, মন্ত্রণালয় তা জানে কিন্তু হাতেনাতে ধরতে পারে না—এই ব্যর্থতার দায় তবে কে নেবে? চুরি হবে আর মন্ত্রণালয় তা জেনেও কিছু করতে পারবে না! প্রথম আলোর প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টদের চুরি-দুর্নীতির বিষয়টি অনেকটাই হাতেনাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আর কী কী প্রমাণ লাগবে? 

শুধু তিতাস নয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরতে পরতে দুর্নীতি ও অনিয়ম বাসা বেঁধেছে। এর আগে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা কেলেঙ্কারির ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কেউ শাস্তি পাননি। আবার সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুধু তিতাস বা পেট্রোবাংলায়ই যে ঘুষ লেনদেন হয়, তা ভাবার কারণ নেই। বিদ্যুৎ, ওয়াসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ সব বিভাগেই কম–বেশি দুর্নীতি আছে। আক্ষেপ বিদ্যুৎসচিবের মতো সরকারের নীতিনির্ধারক ও নির্বাহীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে সেটি স্বীকার করলেও প্রতিকারের বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব রয়েছেন। 

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সম্প্রতি অভিযোগপত্র দায়ের করার আগে সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না বলে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা তার পুনর্বিবেচনার দাবি রাখি। এ ধরনের  সিদ্ধান্ত বা আইন দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের আশকারা দেবে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহিষ্ণুতার ঘোষণাকে প্রহসনে পরিণত করবে।

 তিতাসের উৎকোচ গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনা হোক।