আপনার যদি কিডনির সমস্যা থাকে

কিডনি রোগীদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে চিকিৎসা নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন।
কিডনি রোগীদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে চিকিৎসা নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা বেশ জোর দিয়েই বলছেন, কিডনি রোগীদের অর্ধেক চিকিৎসায় ভালো হয়ে যান। অবশ্য তারপর তাঁদের বেশ সতর্ক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। আর বাকি অর্ধেকের প্রায় সবাই নিয়মিত চিকিৎসায় বেশ কয়েক বছর আয়ু বাড়িয়ে নিতে পারেন। মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ কিডনি রোগীর অবস্থা বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায়। তাঁদের জন্যও চিকিৎসা আছে।

এর চেয়ে বড় সুখবর আর কী হতে পারে! কিডনি রোগীদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে চিকিৎসা নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারেন। কিডনি রোগীদের জন্য উৎসাহিত হওয়ার মতো এই কথাগুলো বলেছেন অধ্যাপক হারুনুর রশিদ। তিনি কিডনি ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের সভাপতি। কিডনি রোগের চিকিৎসায় তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। সম্প্রতি প্রথম আলো ও বিআরবি হসপিটালসের উদ্যোগে
আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কথার তাৎপর্য গভীর।

অধ্যাপক হারুনুর রশিদ জানিয়েছেন, কিডনি রোগের প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের রোগীদের প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা দিয়ে রোগ নিরাময় করা সম্ভব। নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই, তবে অনুমান করা হয়, এ রকম রোগীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। তাহলে সুচিকিৎসায় প্রায় এক কোটি কিডনি
রোগী নিরাপদ।

তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরে, একটু খারাপ অবস্থায় যাঁরা আছেন, সুচিকিৎসায় তাঁদের আয়ু বেশ কিছু বছর বাড়ানো যায়। বাকি অল্প কিছুসংখ্যক রোগী পঞ্চম স্তরে। তাঁদের জন্যও বিশেষায়িত হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা আছে।

আমি দু-চারজন রোগীর কথা জানি, সপ্তাহে দুই দিন যাঁদের কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়। এরপরও বেশ সুস্থ স্বাভাবিক জীবন চালাচ্ছেন। বেশ কর্মক্ষম। আরেকজন কিডনি রোগীর অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে সবাই তাঁর জীবনের আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপনের পর তিনি এখন নিজ কর্মক্ষেত্রে আশাতিরিক্ত উদ্যম নিয়ে একেবারে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।

এটা ঠিক যে কিডনি চিকিৎসা ব্যয়বহুল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কম। রোগী বেশি। অনেক রোগী দিশেহারা হয়ে যান। কিন্তু একটু সচেতন হলে হয়তো কিডনি রোগে এমন বিপন্ন অবস্থায় পড়তে হয় না। এ কথাটিই সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন।

মুশকিল হলো, কিডনি রোগ একটি নীরব ঘাতকের মতো। কখন ধীরে ধীরে একজনের কিডনি আক্রান্ত হচ্ছে, তা হয়তো বোঝা যায় না। পরে তৃতীয়-চতুর্থ স্তরে গিয়ে তাঁকে বিপন্ন অবস্থায় পড়তে হয়।

তাই দরকার সচেতনতা। কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য। সরকারের একটি গাইডলাইন থাকতে হবে। বছরে একবার অন্তত সবাই যেন দুটি পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন, সে ব্যবস্থা দরকার। খুব সহজ দুটি পরীক্ষা। প্রস্রাবে অ্যালবুমিন ক্ষতিকর মাত্রায় আছে কি না এবং ক্রিয়েটেনিন পরীক্ষা। সেটা গ্রহণযোগ্য পরিমাপের সীমার মধ্যে আছে কি না।

দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে, কমিউনিটি ক্লিনিকে, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে খুব কম খরচে যদি এই পরীক্ষাগুলো করানোর ব্যবস্থা থাকে, তাহলে মানুষ বিরাট একটি অভিশাপ থেকে বেঁচে যাবে। কারণ, কিডনি রোগ প্রথম স্তরেই ধরা পড়বে এবং সেটা নিরাময়যোগ্য।

কিন্তু রোগ যেন না হয়, সে চেষ্টাই করতে হবে। মানুষ যদি ভেজাল বা কীটনাশকে বিষাক্ত খাবার না খায়, পরিমিত পানি পান করে, প্রস্রাব চেপে না রাখে, তাহলে কিডনি রোগের আশঙ্কা অনেক কমে যায়। তবে ওষুধের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

যেমন ব্যথানাশক ওষুধ কিডনির ক্ষতি করে। অবশ্য প্যারাসিটামল তেমন ক্ষতিকর নয়। নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে কিডনির সমস্যা হতে পারে। এসব সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এখানে ডাক্তারের ভূমিকাও খুব বেশি। কারণ, তাঁদের কাছে রোগী এলে সতর্কভাবে ওষুধ দিতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক যেন প্রেসক্রিপশনে লিখে না দেন। কারণ, সব ওষুধ কিডনি দিয়ে যায়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে।

আরেকটা কথা। সবাই হাঁটা-চলাফেরা করুন। যাঁরা অফিসে চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করেন, তাঁদের দিনে অন্তত ২৫-৩০ মিনিট ব্যায়াম অবশ্যই করতে হবে। জোরে হাঁটা, সামান্য দৌড়, বুকভরে শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়া বা সহজ ভাষায় যাকে বলি ব্রিদিং এক্সারসাইজ, সেটা করতে হবে। আমরা অনেক সময় বলি, সময় নেই। আসলে সময় বের করার একটি ভালো উপায় আছে।

ধরে নিন আপনার জন্য ২৩ ঘণ্টায় এক দিন। বাকি এক ঘণ্টা রেখে দিন আপনার দৈনিক ব্যায়াম ও ব্যায়ামের প্রস্তুতির জন্য। যদি অন্য কোনো সমস্যা না থাকে, সকালে আধা ঘণ্টা জোরে হাঁটুন। আপনি সারা দিনের কাজের জন্য একেবারে ফিট হয়ে গেলেন। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে।

ভাজাপোড়া, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি, বিড়ি-সিগারেট খাবেন না। এগুলো শুধু কিডনি নয়, আপনার হার্ট-লাঙস সবকিছু নষ্ট করে। যেকোনো প্রক্রিয়াজাত খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ওজন বাড়ায় আর আপনার আয়ু কমায়। এগুলো এড়িয়ে চলুন। সেদিন আলোচনায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেছেন, সন্তানসম্ভবা নারীদের অবশ্যই ইউরিন টেস্ট করে দেখতে হবে তাঁদের কিডনির সমস্যা আছে কি না। তাহলে চিকিৎসা ও সতর্কতার মাধ্যমে তাঁর সুস্থ-স্বাভাবিক সন্তান আসবে।

অনেকের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকে। তাঁদের কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এ দুটি বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। রোগ দুটি যেভাবেই হোক নিয়ন্ত্রণে রাখলে ভয় কম। একজন বিশেষজ্ঞ সেদিন বলেছেন, রক্তচাপ যদি ১৪০-৯০-এর নিচে থাকে, তাহলে কিডনি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। অবশ্য সাধারণভাবে ১২০-৮০ হলো রক্তচাপের নিশ্চিন্ত মাত্রা। এর হেরফের হলে তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আসলে আমাদের জীবনে এত বেশি টেনশন, শহরে এত বেশি বায়ুদূষণ। গ্রামেও দেখা যায় নদী-পুকুর-খাল-বিল দূষণ। খাদ্যে এত ভেজাল। বেঁচে থাকাই কঠিন। কিন্তু তার মধ্যেও আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। এখন তো প্রায় ৭৩ বছর। এটা সম্ভব হয়েছে মূলত স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমে। মানুষের সচেতনতাও সেখানে বড় ভূমিকা রাখছে।

শুধু কিডনি নয়, যেকোনো অসংক্রামক ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকার জন্য সচেতনতা দরকার। একটু সচেতন হলে অসুখ-বিসুখ থেকে আমরা সহজেই মুক্ত থাকতে পারি।

আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক