জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে জাতিসংঘের তরফে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি বিশেষ ঘটনা ঘটল। কিন্তু তাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে না। জাতিসংঘের আওতায় গঠিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের প্রাক্‌–বিচার আদালতের রায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করা এবং জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারকে গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করার সপক্ষে যে অগ্রগতি ঘটেছে, তা মাইলফলক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটা একটা শাঁখের করাত অবস্থা।

 বাংলাদেশ মানবতার দাবিতে মিয়ানমারের অভিযুক্ত জেনারেলদের বিচার চাইছে। আবার নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ এই দেশটির সঙ্গে সীমান্তের অভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় যৌথ অভিযানও বন্ধ রাখছে না। অন্যদিকে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠাতে খুব বেশি দেরি করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে সামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতার বিষয়ে বাংলাদেশ নিজের গরজে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কতটা ধারণা দিতে সচেষ্ট, তা খুব পরিষ্কার নয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে যোগ দেবেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন গত শুক্রবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, বাংলাদেশ এবারও রোহিঙ্গা ইস্যুকে প্রাধান্য দেবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণে গুরুত্ব পাবে বিষয়টি। এ ধরনের আনুষ্ঠানিক উপলক্ষকে কাজে লাগিয়ে বরফ গলানোর কাজ কতটা সফল হবে, তা সত্যিই এক বড় প্রশ্ন। আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের জোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে বাংলাদেশ। এটা স্বাভাবিক এবং রুটিন কূটনৈতিক তৎপরতা। আমরা নিশ্চয় আশা করব, সমর্থন আদায়ে বাংলাদেশ তার পক্ষে সম্ভব সব রকম চেষ্টাই চালাবে। এবং আমরা এটাও মনে করি যে ওই দুটি বিশেষ ঘটনা যা মিয়ানমারের ওপর বেশ চাপ তৈরি করেছে, তাতে বাংলাদেশ কূটনীতির একটা পরোক্ষ সাফল্য নিশ্চয় আছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সামর্থ্য অত্যন্ত সীমিত। সেটা সম্পদের অপ্রতুলতা, জনসংখ্যার ঘনত্ব, পরিবেশ, রাজনৈতিক মাত্রার সঙ্গেই যে তা কেবল সংশ্লিষ্ট তা নয়। বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ বা তাদের ওপর কার্যকর নজরদারি বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব।

আমরা দেখছি যে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কিছু উদ্বেগজনক খুনখারাবির ঘটনাও ঘটেছে। আর রূঢ় হলেও এ কথা বড় সত্য যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত ত্রাণতৎপরতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা কার্যত মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। অন্য অনেক উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশ উদ্বাস্তুদের জন্য কর্মসংস্থান করতে অপারগ। ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা পর্যন্ত নিশ্চিত করার জায়গায় সে নেই।

প্রধানমন্ত্রী এবার রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ‘অনুকরণীয়, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের’ জন্য দুটি সম্মাননা পাবেন। এই সম্মাননা কার্যত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতি প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে দেবে। বাংলাদেশকে তাই তার সামর্থ্যের দিকে সতর্ক থেকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত দেশে ফেরানোর কার্যকর কূটনীতির সাফল্য দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট করতে হবে। বিচারিক প্রক্রিয়া বেগবান করার পাশাপাশি বাংলাদেশের ঘাড়ে প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার যে বোঝা চেপে আছে, তা থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজনে কার্যকর অথচ অপ্রচলিত কূটনীতির আশ্রয়ও নিতে হবে। প্রচলিত কূটনীতি তাকে যে তেমন সাফল্য দেবে না, সেটা সম্ভবত ইতিমধ্যে খুবই পরিষ্কার হয়ে গেছে। এটা একটা অস্বস্তির বিষয় যে এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতিই দৃশ্যমান নয়।