আইনটির বিষাক্ত কাঁটা সরিয়ে নিন

মানবসম্পদ উন্নয়নসহ অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্জন এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশের চেয়ে ভালো। মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দাতা দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুললেও আইনশৃঙ্খলার অবস্থাও অনেক দেশের তুলনায় ভালো। সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি নির্মম, এমন অভিযোগ অবশ্য দেশের বাইরে থেকেও প্রায়ই ধ্বনিত হচ্ছে। এর মধ্যে চতুর্দিকের আপত্তি ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত উপেক্ষা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হয়েছে। এই আইন নিয়ে দেশের মানুষ শুধু নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আইনটি সংসদে পাসের তিন দিন আগে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘বিশ্বে বাংলাদেশেই প্রথম এ আইন প্রণীত হতে যাচ্ছে।’ [বাংলাদেশ প্রতিদিন]

যেহেতু বাংলাদেশেই প্রথম এ ধরনের আইন হতে যাচ্ছে, সাইবার অপরাধ দমনে এ ধরনের আইন ভূমিকা রাখবে। সুতরাং আইনটি এমন হতে পারত যা বিশ্বে দৃষ্টান্তস্থানীয়। কিন্তু তার পরিবর্তে আইনটির গুণগত মান ও নৈতিক দিক নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি আরও বলেছেন, তথ্য অধিকার আইনে বর্ণিত নাগরিক অধিকার সমুন্নত রেখেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী সংবাদ পরিবেশনের জন্য এ আইন অন্তরায় হবে না, তবে দাপ্তরিক গোপনীয়তা লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

আইনটি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এটি তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গেই যে সাংঘর্ষিক তা–ই নয়, সংবিধানের মূল নীতিরও পরিপন্থী। দুর্নীতি কমিয়ে আনা সরকারের অঙ্গীকার কিন্তু ‘দাপ্তরিক গোপনীয়তা লঙ্ঘন শাস্তিযোগ্য’ বলে বিবেচিত হওয়ায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করা সংবাদকর্মীদের পক্ষে অসম্ভব হবে। তাতে সরকারের জবাবদিহির জায়গাটি দুর্বল করে ফেলা হলো এবং সরকার হবে দুর্নীতিবান্ধব। ফলে সরকারের অনেক অর্জন আড়ালে পড়ে যাবে।

আইনটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৩৯তম অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেছেন, এই আইনের মাধ্যমে মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষা না দিয়ে সরকার তা থেকে সরে গেছে। আইনটি সংশোধনের সুপারিশ করেছেন তাঁরা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এক বিবৃতিতে সরকারকে এই আইন কার্যকর করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) শনিবার এক বিবৃতিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলে স্বাক্ষর না করার জন্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে আহ্বান জানিয়েছে। আইনটি সংসদে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেছে তারা। রাষ্ট্রপতিকে লেখা সিপিজের এশিয়া সমন্বয়ক স্টিভেন বাটলার স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, আইনটি বলবৎ হয়ে গেলে বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা বিঘ্নিত হবে। প্রস্তাবিত আইনটির বিভিন্ন ধারা কীভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করবে, তা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন—ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গর্ব করার মতো ইতিহাস বাংলাদেশের রয়েছে। সেই সঙ্গে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় শক্তিশালী প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে এ পরম্পরা হুমকির মুখে পড়বে। এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় গণতান্ত্রিক সমাজে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি রয়েছে, সেটি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এই আইনটি রচনা করার সময় থেকেই মানুষের মধ্যে সংশয় দেখা দেয় এবং আইনটি যাতে মতপ্রকাশের পথে বাধা না হয় এবং সাংবাদিকদের জন্য বিপজ্জনক না হয়, সে জন্য উদ্বেগ জানানো হয়। এর অনেক আগে থেকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের জন্য দাবি জানানো হচ্ছে। কারণ, এই ধারাটি একটি শক্তিশালী কালাকানুন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর দেখা গেল সেই ৫৭ ধারার উপাদানগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কয়েকটি ধারায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার অর্থ হলো এই এক গ্লাস শরবতের ভেতরে বিষ ছিল। সেই শরবতের পাত্রটি সরিয়ে ফেলা হলো, কিন্তু শরবতটি ভাত, ডালের বাটি, ভাজি এবং দুধের মধ্যে সমপরিমাণে মিশিয়ে খেতে দেওয়া হলো। তাতে যে বিষক্রিয়া কমবে, সে সম্ভাবনা নেই। বরং যোগ হয়েছে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের নতুন বিষ।

সবচেয়ে দুঃখজনক ও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো আইনটির ধারাগুলো নিয়ে যখন দেশে-বিদেশে কথা হচ্ছে, তখন আমাদের সংসদের সরকারি ও আধা-সরকারি দলের ১০ জন সদস্যও আইনটির ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলেন না। কখনো আইনটি যদি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সংশোধন করা হয়ও, একদিন এ দেশের মানুষ বর্তমান সংসদের ৩৫০ জন সাংসদকে মনে রাখবে এই জন্য যে তাঁদের কারও ভিন্নমত দেওয়ার সৎসাহস ছিল না। তাঁদের জন্য বিষয়টি অতি অগৌরবের। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি দলের বহু সদস্য কোনো কোনো প্রশ্নে স্বাধীন মত প্রকাশ করেন। সরকারের সমর্থক সবাই যদি সব ব্যাপারে একমত পোষণ করেন, তাহলে সংসদে কোরামের প্রয়োজন নেই—একজন মাত্র সদস্য উপস্থিত থাকলেই যথেষ্ট।

এই বিপজ্জনক আইনটির যাঁরা দেশের ভেতর থেকে বিরোধিতা করেছেন, তাঁরা সরকারের অনেক ব্যাপারে সমালোচনা করলেও তাঁদের কেউ কেউ সরকারবিরোধী নন। এই আইন দ্বারা কে কখন অকারণ নিগ্রহের শিকার হবেন তা বলা যায় না। এই আইনের প্রশ্নে এখন যাঁরা নীরবতা অবলম্বন করছেন, এর বিষাক্ত তির একদিন তাঁদের এবং তাঁদের প্রিয়জনদের জীবনকেও ক্ষতবিক্ষত করতে পারে।

যেকোনো আইন রাষ্ট্রের সব মানুষের জন্য, কিন্তু এই–জাতীয় আইন শুধু ক্ষমতাসীনদের অবারিত সুযোগ করে দেয়। তার বাইরে যারা তাদের সবার গলার ওপরে ধারালো তলোয়ারের মতো ঝুলতে থাকে। পুলিশকে গ্রেপ্তারের যে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, তাতে এ আইনের অপব্যবহার অবধারিত, ইচ্ছা করলে যে কেউ তার শত্রুকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে।

এই আইন একাডেমিক গবেষকদের জন্যও খুব বড় বিপজ্জনক। বিশেষ করে যাঁরা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনুসন্ধানমূলক কাজ করবেন, তাঁদের জন্য আইনটি বিপজ্জনক। কোনো বিষয়ে একই তত্ত্ব চিরকাল টেকে না। তাতে যোগ হয় নতুন নতুন উপাদান। সভ্য সমাজ তাতে আপত্তি করে না, বরং মেনে নেয়। ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়। ইতিহাসের ভুলগুলো দূর হয়। সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। গ্যালিলিও বা কপারনিকাসের শাসকদের মানুষ মনে রাখেনি, তাঁরা চিরস্মরণীয়। নতুন কথা বলতে দিতে হবে। সে কথা যদি আমরা বিশ্বাস না–ও করি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষাক্ত কাঁটা থেকে শুধু সাংবাদিকেরা মুক্তি চান না, সব মানুষ চায়। আমরা আশা করব, তার আগেই আইনটি থেকে বিষাক্ত কাঁটা সরিয়ে নেওয়া হবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক