এবার ট্রাম্প নতুন কী বলবেন?

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

এক সপ্তাহ আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশন। প্রথম সপ্তাহটি গেছে অধিবেশনের সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিতে। অধিবেশনের সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ, বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে সাধারণ বিতর্ক, শুরু হচ্ছে (আজ) মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর। চলবে ১ অক্টোবর পর্যন্ত। পরিষদের ঐতিহ্য অনুসারে প্রথম দিনের অধিবেশনেই ভাষণ দেবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত বছর প্রথমবারের মতো বিশ্বসভায় ভাষণ দিতে এসে ট্রাম্প এই সংস্থার গুরুত্ব খাটো করে দেখিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রত্যাখ্যান করে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণের কথা ঘোষণা করেছিলেন, উত্তর কোরিয়ার নেতাকে ‘রকেটম্যান’ বলে উপহাস করেছিলেন এবং সে দেশকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

এবার কী কথা শোনাবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট?

মার্কিন সূত্র অনুসারে, এ বছর ট্রাম্পের নজর থাকবে ইরানের ওপর। বুধবার তিনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন। পরিষদের কর্মসূচি অনুসারে চলতি মাসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র, সেই সুবাদেই নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি হিসেবে ট্রাম্পের অভিষেক। গত সপ্তাহে মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত নিকি হেইলি জানিয়েছিলেন, ট্রাম্প যে বৈঠকটির সভাপতিত্ব করবেন, তার বিষয় হবে ইরানের আণবিক কর্মসূচি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর দায়িত্ব। রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে, তাদের বক্তব্য ছিল শুধু ইরানের আণবিক কর্মসূচির প্রশ্ন উঠলে তারা সে দেশের সঙ্গে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষে বক্তব্য রাখবে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে
এলেও ইরান ও এসব দেশ এখনো চুক্তিটি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার নিকট মিত্রদের মতানৈক্য খোলামেলাভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়তে পারে, যা ট্রাম্পের জন্য বিব্রতকর হতে পারে।

অন্য বিপদ হবে ইরানের অংশগ্রহণ নিয়ে। যদি আলোচনার বিষয় হয় ইরান, তাহলে পরিষদের কার্যবিধি অনুসারে সে দেশকে বক্তব্য দিতে আহ্বান করার নিয়ম আছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সাধারণ বিতর্কে অংশ নিতে নিউইয়র্কে এসে পৌঁছেছেন। ফলে এই বৈঠকে তাঁকেও আমন্ত্রণ জানাতে হবে। সম্ভবত এই দুই কারণে নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকের বিষয় শুধু ইরান না হয়ে তা সব ধরনের পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রভান্ডার নিয়ন্ত্রণ করার প্রশ্নে আলোচনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

কিন্তু ট্রাম্প নিজে কী করবেন, কারও পক্ষে তা আগাম বলা সম্ভব নয়। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ট্রাম্প ও রুহানির মধ্যে যাতে কোনো সরাসরি সাক্ষাৎ না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা গলদঘর্ম হচ্ছেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের মুখোমুখি সাক্ষাতের ফলে পারমাণবিক যুদ্ধ থামানো গেছে এবং সে জন্য তাঁকে  শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত, ট্রাম্প সে কথা নিজেই বলেছেন। তিনি সেরা ‘ডিলমেকার’, এই বিশ্বাস থেকে ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও সরাসরি বৈঠকের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। জাতিসংঘে এই দুই নেতার মুখোমুখি দেখা হলে ট্রাম্প আবার তেমন প্রস্তাব দেবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

টাইমস জানিয়েছে, গত বছর জাতিসংঘে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অকূটনৈতিক ভাষায় হুংকার দিয়েছিলেন। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা ভয় পাচ্ছেন, এবার হয়তো হবে উল্টো, নিজেকে শান্তিপ্রিয় প্রমাণ করতে ট্রাম্প এবার অতিরিক্ত ‘কূটনীতিক’ হবেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নতুন রূপে সবার মনে আস্থা জাগবে, সে কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক বহুপক্ষীয় কূটনীতি, বিশেষ করে জাতিসংঘ ব্যবস্থার ওপর একের পর এক আঘাত হেনে গেছে। তারা এককভাবে জাতিসংঘের পরিবেশ চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে, ইউরোপীয় অংশীদারদের আপত্তি সত্ত্বেও ইরান চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে, সব আন্তর্জাতিক নীতি লঙ্ঘন করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব পদক্ষেপের পর ট্রাম্পকে ‘কূটনীতিক’ হিসেবে উচ্চ আসনে স্থান দিতে আগ্রহী দেশ খুব কমই থাকার কথা।

এই মনোভাবটি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘে বলিভিয়ার রাষ্ট্রদূত সাশা লরিন্তো সলিৎজ। নিউইয়র্ক টাইমস–এর সাবেক জাতিসংঘ প্রতিনিধি বারবারা ক্রসেটকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘ট্রাম্প মুখে যত কথাই বলুন, গত এক বছরে আমরা দেখেছি তাঁর প্রশাসন কীভাবে আন্তর্জাতিক আইন ও বহুপাক্ষিকতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে। এদের লক্ষ্য একটাই, জাতিসংঘকে নিজের প্রয়োজনে লেবুর মতো ইচ্ছামতো চিবানো। তারপর প্রয়োজন শেষ হলে তাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া।’

কোনো সন্দেহ নেই, আগামী এক সপ্তাহ বিশ্বের নজর থাকবে জাতিসংঘে বিশ্বনেতাদের আলাপ-আলোচনার ওপর। সাধারণ পরিষদের বিতর্কে কোনো পূর্বনির্ধারিত অ্যাজেন্ডা নেই, বিশ্বনেতারা তাঁদের কাছে আন্তর্জাতিক বা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ—এমন বিষয়ে বক্তব্য দেবেন। প্রতিবছর যেসব প্রশ্নে সাধারণত আলোচনা হয়ে থাকে, এ বছরও তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কার্যক্রম, ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংকট ইত্যাদি নিয়মিত বিষয় তো থাকবেই। গত বছর রোহিঙ্গা প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল। শুধু বাংলাদেশ নয়, আরও অনেক দেশই সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এবারও সেই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি হবে।

অনেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে ‘কথার দোকান’ বা ‘টকিং শপ’ নামে অভিহিত করে থাকে, তার এক প্রধান কারণ এই সাংবাৎসরিক সাধারণ বিতর্ক। পূর্বপ্রস্তুত করা লিখিত ভাষণ দেখে নেতারা ভাষণ দিয়ে যান, অনেক সময় তাতে ইতিপূর্বে প্রদত্ত ভাষণের হুবহু মিল রয়ে যায়। প্রথম কয়েক দিনের পর বিতর্কের সময় পরিষদকক্ষে ভাষণ প্রদানকারী নেতা-নেত্রী ও যাঁর যাঁর দেশের প্রতিনিধি ও সমর্থক ছাড়া খুব বেশি লোক আর থাকে না। যে বক্তব্য তাঁরা দেন, তা অনুসরণের বা বাস্তবায়নের কোনো প্রক্রিয়াও নেই। ফলে অধিকাংশ বক্তব্যের আয়ুষ্কাল সামান্য কয়েক দিনের বেশি নয়।

তবে এই সময়কালের গুরুত্ব অন্যত্র। সাধারণ বিতর্কের সূত্র ধরে বিশ্বনেতারা উপস্থিত হন, মূল বিতর্কের বাইরে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে মিলিত হন, দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে মতবিনিময় করেন। মার্কিন তথ্যমাধ্যম ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক জনমতকে প্রভাবিত করার একটি সুযোগও তাঁরা কাজে লাগিয়ে থাকেন। এ বছর যেমন প্রেসিডেন্ট রুহানি মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করতে জাতিসংঘের বাইরে এ দেশের সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মিলিত হবেন। এসব বৈঠকে তাঁর লক্ষ্য হবে ইরানকে একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে উপস্থিত করা। সেই লক্ষ্যে তিনি ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় এক নিবন্ধে পারমাণবিক শান্তির প্রতি ইরানের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

হাসান ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি