সুযোগ হারালেন আরএসএস প্রধান

মোহন ভগবত
মোহন ভগবত

ভারত মুসলমান ছাড়া দেশ নয়—এ কথা বলার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু বলেননি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভগবত। আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্র ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গনির্বিশেষে সবার জন্য সমান নাগরিকত্ব দিয়েছে। অন্য সবার মতো একজন মুসলমানও একজন ভারতীয়। সমস্যার সৃষ্টি তখন হয়, যখন মুসলমানরা তাদের ধর্মের কারণে বৈষম্যের শিকার হয়। এ দেশের মুসলমানরা হিন্দুত্ববাদের সমর্থকদের কাছ থেকে ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হচ্ছে।

ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির দ্বারা তারা দুর্বল হয়ে উঠছে। ঘর ওয়াপসি, রামজাদে-হারামজাদে, লাভ জিহাদ, পাকিস্তানে ফিরে যাও ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার এবং গোরক্ষকদের হাতে মৃত্যুবরণ ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়কে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলেছে, যারা কিনা আগে থেকেই পিছিয়ে আছে। মোহন ভগবত এটা ব্যাখ্যা করার সুযোগ হারিয়েছেন যে আরএসএসের ধারণায় ভারত হচ্ছে এমন একটি দেশ, যা ন্যায়বিচার ও সমতার সাংবিধানিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত।

আরএসএস তাদের মিশন সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করছে, যেখানে তারা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানায়। তারা মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নের জন্যও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তারা খুব একটা সফল হয়নি। মুসলমানরা আরএসএসের মতাদর্শকে এখনো ভয় পায়। সাম্প্রতিক সময়ে আরএসএস আবার হিন্দুধর্মের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদের ধারণা মিশ্রণ করেছে। আরএসএস কেন্দ্রে এবং অনেক রাজ্যে বিজেপির প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমর্থন করছে। প্রকৃতপক্ষে তারা দেশের বেশ কিছু অংশে বহু বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে।

মোহন ভগবতের একটি নতুন সূচনা করার সুযোগ ছিল, এ কথা বলার মধ্য দিয়ে যে মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং অন্য সংখ্যালঘুরা ভারতের সমান নাগরিক এবং এ বিষয়ে কারও কোনো ধরনের সন্দেহ থাকা উচিত নয়। তিনি বলতে পারতেন যে গোরক্ষকদের হাতে মুসলমানদের হত্যাকাণ্ড অবশ্যই অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

তিনি বিজেপিকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারতেন, ‘সাবকা সাথ সাবকা বিকাশ’ স্লোগান সঙ্গে নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদির এটাই ছিল স্লোগান। বিজেপি সরকারের অধীনে রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদের স্পষ্টভাবে বর্জন করা হয়েছে। 
সরকারের কল্যাণমূলক ও দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচিগুলো থেকে মুসলমানদের বাদ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য কয়েক দশক ধরেই মুসলমানরা এ দেশে অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

আমাদের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র ও ধর্ম দুটি আলাদা জিনিস। এর অর্থ হচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো মিশ্রণ হতে পারবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে বাস্তবতাটি ভিন্ন। কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিজেপি সব রাজনৈতিক দল, এমনকি আঞ্চলিক দলগুলোও রাজনৈতিকভাবে ধর্মের বিষয়টিকে সামনে এনেছে। সংখ্যালঘুদের বর্জন করেছে।

হিন্দুধর্ম একটি ধর্ম, ভারতের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ যে ধর্মের অনুসারী। সবাইকে বাদ দিয়ে হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনার বিষয়টিতে অধিকাংশ হিন্দুরই সমর্থন পাওয়া যায় না। এ ছাড়া অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা হিন্দু নন কিন্তু হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যময় চরিত্রের প্রশংসা করেন।

সমস্যার সৃষ্টি হয় তখনই, যখন হিন্দুত্ববাদকে স্পষ্টভাবে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিণত করা হয় এবং সে অনুযায়ী কাজ করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চরমপন্থী কোনো মতাদর্শ বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজে সফল হতে পারে না।

আরএসএস হয়তো এটা অনুধাবন করতে পারছে যে সফল হওয়ার জন্য কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকা প্রয়োজন, যেটা সমাজের সব ক্ষেত্রের মানুষ সমর্থন করবে। তাদের বুঝতে হবে যে তাদের চিন্তা সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। পাশাপাশি পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাদের বিকশিত হওয়ার এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের কথা ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।

ভারত কর্মসংস্থান, শিক্ষা, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, কৃষকদের আত্মহত্যা, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাসহ অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সংখ্যালঘুদের ওপর ভিত্তি করে গৎবাঁধা ধর্মের রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের সুযোগ খুবই কম। সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে তার সমর্থন বাড়িয়ে তুলতে হলে আরএসএসকে অবশ্যই বাস্তবসম্মত ও সবার জন্য কল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া

জাকিয়া সোমান ভারতের নারী অধিকারকর্মী