ভাসমান হাসপাতাল

প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধির পাঠানো খবর অনুযায়ী, শীতলক্ষ্যা নদীতে নোঙর করা ‘জীবনতরী’ আড়াই মাস ধরে এলাকার মানুষকে স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর সেবাপ্রার্থীরা এলাকার দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, যাদের পক্ষে দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ভঙ্গুর যোগাযোগব্যবস্থা ছাড়াও আর্থিক অসচ্ছলতা বড় বাধা। সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।

 ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামের বেসরকারি সংগঠনটি জীবনতরী নামের ভাসমান হাসপাতালটি চালু করে ১৯৯৯ সালে। ১২ শয্যার এই হাসপাতালটিতে চিকিৎসক আছেন তিনজন; যাঁদের একজন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ, একজন চোখের, একজন অর্থোপেডিকসের। চারজন নার্স, দুজন কর্মকর্তাসহ মোট ৩৫ জন জনবল আছে হাসপাতালে। মুমূর্ষু রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য স্পিডবোট আছে দুটি। এই ভাসমান হাসপাতাল দেশের নদীতীরবর্তী হাজার হাজার মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। তাদের দেওয়া চিকিৎসাসেবার মধ্যে আছে নাক, কান, গলা ও চক্ষু রোগীদের চিকিৎসা ও বিশেষজ্ঞ সার্জন দিয়ে অস্ত্রোপচার এবং হাড়জোড়া, হাড়ভাঙা, পঙ্গু, জন্মগত ঠোঁটকাটা-তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসা, প্লাস্টিক সার্জারি। এ ছাড়াহাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইমাম, স্বাস্থ্যকর্মী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ধাত্রীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে, যার উদ্দেশ্য হলো চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার আছে, সেগুলো দূর করা। এখনো গ্রামাঞ্চলে বহু মানুষ রোগ থেকে রেহাই পেতে কবিরাজ-ওঝা প্রমুখের কাছে গিয়ে প্রতারিত হয়।

জীবনতরীর উদ্যোগ যত ছোটই হোক না কেন, অসুস্থ মানুষের জীবনে আশার আলো দেখাচ্ছে। সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা একজন রোগী বলেছেন, ‘মানুষ হাসপাতালে যায় চিকিৎসা নিতে, কিন্তু হাসপাতাল রোগীর বাড়ির ঘাটে আসে, তা আগে দেখিনি।’ চিকিৎসাসেবায় বাংলাদেশের সাফল্য অনেক। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক হ্রাস পেয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। কিন্তু এখনো আমরা সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারিনি। সেটি করতে হলে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যেতে হবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। বিশেষ করে, যেখানে সড়ক ও রেল যোগাযোগ অপ্রতুল, সেখানে ভাসমান হাসপাতাল হতে পারে বিকল্প স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যম। সরকার সরাসরি এ ধরনের উদ্যোগ নিলে কতটা সফল হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বরং বেসরকারি উদ্যোগে তারা সক্রিয় সহযোগিতা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্থানে ভাসমান হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

এ ধরনের বেসরকারি উদ্যোগ আমাদের আশান্বিত করে। একই সঙ্গে চিকিৎসাব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থার কথাও মনে করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও দেশের সব জায়গায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে না পারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ব্যর্থতা বলেই আমরা মনে করি। জীবনতরী স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত মানুষের জীবনে আশার আলো দেখাক।