বেশি ভোটার, বেশি বৈধতা

বিরোধী দলকে যত বেশি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে, নির্বাচনে তত বেশি ভোটার বাড়বে
বিরোধী দলকে যত বেশি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে, নির্বাচনে তত বেশি ভোটার বাড়বে

গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পাব—এই ভাবনা আমাদের একটা স্বস্তি দিচ্ছে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয় কি না, সেই প্রশ্ন ভোটের দিন পর্যন্ত ঝুলতে থাকবে। তবে প্রধান দলগুলো যদি নির্বাচনী প্রচারণাকে শান্তিপূর্ণ এবং একটি উৎসবমুখর পরিবেশে রূপ দিতে পারে, তাহলে ভোটের দিনে অধিকতর ভোটার টানতে তা বড় ভূমিকা রাখবে।

একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, কোনো সাধারণ নির্বাচনে ৬০ শতাংশ ভোটার এলেই তাকে ভালো নির্বাচন বলা চলে। তিনি আশাবাদী, আসন্ন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ৬০ ভাগ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য যে ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের ঐতিহাসিক নির্বাচনে ভোটারদের হার ছিল ৫৭.৬৮ ভাগ। ১৯৭৩ সালে এই হার ছিল ৫৪.৯১ শতাংশ। ৪৮ বছরের ব্যবধানে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা এবং জনসচেতনতার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। আর আমরা এক দিনের গণতন্ত্রকেই উদ্যাপন করছি। আমাদের সংস্কৃতির মন্ত্র হলো, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পায়, তারাই রাজা। অন্যরা ফকির। তাই এখন ৬০ ভাগ ভোটার উপস্থিতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারি না।

অবশ্য এ প্রসঙ্গে আমরা মনে রাখব, প্রচলিত ভোটাভুটিনির্ভর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী একটা দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম বড় প্রমাণ, ভোটাররা ক্রমেই নিরাসক্ত হয়ে পড়ছেন। নব্বইয়ের দশক থেকেই ভোটদানের হার নিম্নমুখী। এটা গণতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং পদ্ধতি হিসেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমস্যা নির্দেশক। সুইডেনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স (আইডিইএ), যারা ১৯৯৯ থেকে বিশ্বব্যাপী ভোটের হার পর্যবেক্ষণ করছে, তারা বলছে, ভোটারদের নিম্নহার এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে জনগণ ভোট নামের হাতিয়ার দিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণকারী দলগুলোকে বৈধতা দিতে অনাগ্রহী।

গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বকারী মূল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা আর স্বীকার করে নিতে চাইছে না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে নাগরিকেরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছেন। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের নাগরিক আন্দোলনের উত্থান ঘটাচ্ছেন। দলহীন অচেনা নাগরিকেরা বড় বড় সফল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই অচেনা মুখগুলোর সঙ্গে চেনা মুখগুলোর ব্যবধান হলো, প্রথমোক্তের সঙ্গে জনগণের পদ্ধতিগত কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু শেষোক্তের সঙ্গে জনগণের পদ্ধতিগত সম্পর্ক আছে। আর সেই সম্পর্ক ইউরোপে যেমন, উন্নত বিশ্বে যেমন, তেমনটা উন্নয়নশীল বা গণতন্ত্রে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে নিশ্চয়ই নেই।

জবাবদিহির সঙ্গে বৈধতার সম্পর্ক সব থেকে জোরালো। এ কারণে পাশ্চাত্য বহু ধরনের কলাকৌশল বের করেছে। তারা রিকল ব্যবস্থা (কোনো সাংসদের প্রতি অনাস্থা দেখা দিলে নির্দিষ্ট আসনে মধ্যবর্তী নির্বাচন করা) চালু করেছে। গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের ওপর গণভোট করছে। তারা ভোটারদের সরাসরি গণতন্ত্রের স্বাদ দিচ্ছে। এসবের মাধ্যমে ওই সব দেশে একটা মিথ ভেঙে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কারণ, অনেক দেশের পেশাদার রাজনীতিকেরা এটা দাবি করতেই পছন্দ করেন যে জনগণ তাঁকে নির্দিষ্ট মেয়াদে শাসক হতে ম্যান্ডেট দিয়েছে। কিন্তু কার্যকর গণতন্ত্র তা বলে না। নির্বাচনে দলগুলোর অংশগ্রহণ কিংবা বিপুল ভোটারের উপস্থিতি, এসবের কোনো কিছুই আর প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পরিপূরক নয়।

স্বাধীন গণমাধ্যমের যে দাবি, সেটাও কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রের দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয় নয়। স্বাধীন গণমাধ্যম জনগণকে সরাসরি গণতন্ত্র কিংবা কার্যকর ভোটাধিকারের স্বাদ দিতে পারে। আবার শাসনব্যবস্থা বা কাঠামো এমন হতে পারে যে কোনো ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠী তা তিনি বা তাঁরা যতই ক্ষমতাধর হোন না কেন, চাইলেই অগাধ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই বিতর্কিত বর্ণবাদী প্রথম আদেশ, যা দিয়ে তিনি কয়েকটি মুসলিম দেশের অভিবাসীদের বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন, তাঁকে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, তিনি একজন জেলা জজ মাত্র। সুতরাং আমেরিকার নির্বাচনে ২০১৪ সালে (প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট নির্বাচন) মাত্র ৪২.৫০ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন বলেই সেটা সেই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্য যাচাইয়ের মানদণ্ড নয়।

আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে বাংলাদেশের দলগুলো এখনো পর্যন্ত নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তাতে বুঁদ হয়ে থাকার কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মান উন্নত করার কোনো আলোচনা পর্যন্ত শুরু হতে পারছে না। নির্বাচনকালীন বিরোধীদলীয় মোর্চার যত আকুলিবিকুলি এবং সরকারি দলের যত প্রকারের উদ্বেগ—সেটাও ওই এক দিনের ভোটকেন্দ্রিক। এক দিনের গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু চিন্তা করা উচিত। ডামাডোলের মধ্যেই রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো যায়। যেমন একটা শঙ্কা, বিএনপি এলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সাংসদদের অনেকেই মনোনয়ন পাবেন না।

শোনা যাচ্ছে, প্রতি তিনজনে একজন বাদ পড়তে পারেন। যদি আইনে একটা পরিবর্তন আনা হয় যে রিকল করা যাবে। তাহলে ক্ষমতাসীন দল গণতান্ত্রিক উপায়ে সাংসদ বদলাতে পারে। এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা দলের হাইকমান্ডের বিবেচনায় বহু আগে অনুপযুক্ত বলে শনাক্ত হয়ে আছেন। কিন্তু উপায় না থাকার কারণে দলকে তাঁদের বোঝা বইতে হচ্ছে।

আইডিইএ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ সালে বাংলাদেশ (এর আগের বছরে পাকিস্তান ৫৩.৬২ ভাগ) যখন ৫১.৩৭ ভাগ ভোটারের (সুজনের মতে, ৪০. ০৪ ভাগ) অংশগ্রহণে নির্বাচন করেছে, তখন পরের বছর সুইজারল্যান্ডে নির্বাচন হয়েছে ৪৮.৪০ ভাগ ভোটারের অংশগ্রহণে। এখন কেউ নিশ্চয়ই ভোটারদের উপস্থিতির হার দিয়ে সুইস গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের তুলনা করতে বসবেন না।

অবশ্য ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের ফলাফলের শুদ্ধতার প্রশ্ন ভুললে চলবে না। আবার এটাও সত্য যে ১৯৬টি দেশের মধ্যে তালিকার তলানিতে থাকা টপ টেনের হাইতি, গাম্বিয়া, মিসর, গ্যাবন, আইভরি কোস্ট, সেনেগাল, মালি, পালাউ, জিম্বাবুয়ে ও লিবিয়া ২০০৮ থেকে ২০১৫ সালের নির্বাচনে ১৮ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশের মধ্যে ভোটার প্রত্যক্ষ করেছে। এসব তথ্য নির্দেশ করছে যে শুধু নির্বাচন নামের একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান দিয়ে রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুণগত মান বা তার কার্যকারিতা যাচাই করা যাবে না। আমরা উল্লিখিত বৈশ্বিক প্রবণতা ও পরিস্থিতি মনে রেখেই উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনের পথের দিকে চেয়ে থাকব।

বাংলাদেশের যা বাস্তবতা, তাতে বলা যায়, বেশি ভোটারই বেশি বৈধতা নিশ্চিত করবে। কিন্তু মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি কমাতে হবে। যত বেশি নিরাপত্তা, তত বেশি ভোটার বাড়বে। ভালো প্রার্থী যে আসনে, সেখানেও বেশি ভোটার যাবে। আপাতত এবং আরও কয়েকটি নির্বাচন মেয়াদে আমরা গণতন্ত্র বলতে নির্বাচনকেই বুঝব। এই আমাদের নিয়তি। এই বাস্তবতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি, সেই সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতে দেখি না। কিন্তু আর সে জন্য দরকার প্রাক্নির্বাচনী মাসগুলোকে কম সহিংস, কম অপরাধপ্রবণ করা। বিরোধী দলকে যত বেশি শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে, তত বেশি ভোটার বাড়বে বলে অনুমান করা যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য একটি সর্বজনীন মন্ত্র আছে, সব পরিস্থিতিতে যথাসম্ভব কম শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। পুলিশ যত বেশি ভালো ও ন্যায্য আচরণ করতে পারবে, তত বেশি নির্বাচনী পরিবেশ উত্তম হবে।

প্রতীয়মান হচ্ছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের মধ্যে তিনটিকে (ষষ্ঠ সংসদ বাদ দিয়ে) আমরা বেশি অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বলতে পারি। এই তিন নির্বাচনের গড় ভোট দেওয়ার হার ৬৮.৬৬। এক-এগারোর পরিবেশে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে ইতিহাসের সর্বাধিক ভোটার সমাগম ঘটে। এটা শতকরা ৮৬.৩৪। এক দশকের ব্যবধানে আসন্ন নির্বাচনটিকে আমরা অংশগ্রহণমূলক অনুমান করতে পারি কিন্তু তাতে ৮০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবেন, তা সহজে অনুমান করতে পারি না। অনেক শঙ্কা, অনেক দ্বিধা, নির্বাচনে মানুষের ঢল নামবে তো?

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]