পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ

সম্প্রতি দেশে কোটা সংস্কার ও কোটা বাতিল নিয়ে পানি কম ঘোলা হয়নি! গত ১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতিই আর রাখা হবে না। আবার পরবর্তীকালে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল সম্ভব নয়, হাইকোর্টের রায় আছে।

সংবিধানের ২৮ (৪) ও ২৯ (৩)-এর অনুচ্ছেদ সামনে রেখেই দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির জন্য দেশে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলোতে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে বা নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা সরকারের আছে। তাই বলা যেতে পারে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃত।

দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, বিশেষত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, প্রতিবন্ধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ভৌগোলিকভাবে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষেরা, যারা স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রের সমান সুযোগ থেকে বিভিন্ন কারণে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

আমরা যত দূর জানি, কোটা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও দাবি ছিল কোটা সংস্কার, কোটা বাতিল নয়। অর্থাৎ বর্তমান কোটাব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। কোটাব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হলো অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

১৯৭২ সালে দেশে প্রথম কোটাব্যবস্থা চালু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ২৫৮ ধরনের কোটাব্যবস্থা চালু আছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রথম শ্রেণির চাকরিতে মোট পাঁচ ক্যাটাগরির কোটা বিদ্যমান আছে। সেগুলো হলো মুক্তিযোদ্ধা, জেলা, নারী, উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটা।

১৭ সেপ্টেম্বর কোটা বিষয়ে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি তাদের রিপোর্টে যত দূর সম্ভব কোটা বাদ দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাকে গুরুত্বের সঙ্গে রেফারেন্স টেনে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের বলটি সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে!

অন্যদিকে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা না রাখার বিষয়ে বলেছেন, বিভিন্ন যাচাই-বাছাই করার পরে উচ্চপর্যায়ের কমিটির মনে হয়েছে, এখন তাদের জন্য কোটা না হলেও চলতে পারে!

তাই আমরাও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ কথা পর্যালোচনা কমিটিকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য কোটা সংরক্ষণ করার বিষয়টি সাংবিধানিক অধিকার। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এ মন্তব্যের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত পোষণ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, পর্যালোচনা কমিটি কোন অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে কাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে তাদের জন্য কোটা না হলেও চলবে!

সংবিধানে স্পষ্টভাবে দিকনির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পর্যালোচনা কমিটির এ সুপারিশ কোনোভাবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত হতে পারে না।

আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে একটু তাকাই। ভারতে প্রাদেশিক কোটায় সামান্য তারতম্য থাকলেও সার্বিকভাবে সমাজের দলিত ও শিডিউল ট্রাইবদের জন্য সাংবিধানিকভাবে কোটা বরাদ্দ রাখা আছে। কেবল চাকরির ক্ষেত্রে নয়, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

‘দলিত, সংখ্যালঘু ও উপজাতি বৈষম্য দূরীকরণ আইন’ নামে একটি সাংবিধানিক আইনও আছে। তাদের সংবিধানের ১৭ ধারায় বলা আছে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতি যেকোনো ইচ্ছাকৃত বৈষম্য সৃষ্টি করা বা সাংবিধানিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়বে।

নেপালের কোটাব্যবস্থাও তাদের আইনসভা দ্বারা স্বীকৃত। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন পাকিস্তান, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, কানাডা, আমেরিকাতেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা পদ্ধতি চালু রয়েছে।

জরুরি বিষয়টি হলো, স্বাধীনতার পর থেকে প্রচলিত কোটাব্যবস্থাকে একেবারে বাদ দেওয়ার সুপারিশ থেকে সরে এসে সরকারের উচিত হবে এমন একটি কমিশন গঠন করা, যাতে সেই কমিশন সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে কোটা সংস্কারের বিষয়টিকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে আনতে সক্ষম হয়।

এটি হতে পারে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সদস্যদের নিয়ে, যাঁদের পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সম্মিলন ঘটিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন কমিশন দেশের সম্ভাবনাময় তরুণদের আগামীর পথে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকে আরও তিন ধাপ এগিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক দিক। দেশের জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ের ওপর মানব উন্নয়ন সূচক নির্ধারিত হয়। কিন্তু দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে বাংলাদেশের এ অগ্রগতি বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া কোনোভাবে সম্ভব নয়।

আমরা জানি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের কোটা সংরক্ষণের বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন।

তাই আমরা এখনো আশা করছি, পর্যালোচনা কমিটির প্রস্তাবিত সুপারিশ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কোটা সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা হবে।

ইলিরা দেওয়ান, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
[email protected]