বাবা ছিলেন আমাদের বটবৃক্ষ

ময়েজউদ্দিন আহমেদ
ময়েজউদ্দিন আহমেদ

১৯৮৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। এ দিনটি আমার পরিবারের জন্য একটি শোকাবহ ও বেদনাদায়ক দিন। সেই দিনটি ছিল আমার বলা যায় সর্বস্ব হারানোর দিন। সেই দিনে আমার বাবা ময়েজউদ্দিন আহমেদকে গাজীপুরের কালীগঞ্জে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অথচ তিনি এই কালীগঞ্জেরই মানুষ ছিলেন। এখানকার মাটি ও মানুষকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। এখানকার মানুষের ভালোর জন্য নিরন্তর ভাবতেন তিনি। কিন্তু এই মাটিতেই ঘাতকের নির্মমতায় ঝরে যায় তাঁর শরীরের রক্ত।

আমি তখন চট্টগ্রামে আমার স্বামীর সঙ্গে। আগের রাতে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। রাতটা ছিল বিনিদ্র। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে চলছিল দেশব্যাপী হরতাল। সকালে নাশতার সময় একটা ফোন এল আমার স্বামীর ফোনে। তিনি অফিসে গেলেন। ভাবলাম, অফিসের ফোন পেয়েই বুঝি তাঁর বাইরে যাওয়া। কিছু সময় পরেই ফিরলেন। টেবিলে বসলেন। টেবিলে নাশতা সাজানো। নাশতা না খেয়ে উঠে বাথরুমে গেলেন। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। উঠে তাঁর পেছনে পেছনে বাথরুমের কাছাকাছি গেলাম। ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনছিলাম। বড় কোনো অঘটনের আশঙ্কায় মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল।

আমি জানতে চাইলাম, কী হয়েছে?

তিনি কান্নাচাপা কণ্ঠে বললেন, বাবার শরীর ভালো না। আমি এই কথার মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই বুঝে যাই। আর কিছু বলতে পারি না। হরতাল চলছে। গাড়িঘোড়া তেমন চলছে না। তাই অনেক কষ্টে রাতের ট্রেনে ঢাকায় আসি। কমলাপুর রেলস্টেশনে বাবার এক বন্ধু আমাদের নিতে এসেছিলেন।

৭ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী লেন। এখানে বাবার প্রাণহীন দেহটা রাখা। আমি ওই সময় কেবল মাকে দেখতে চাইছিলাম। মা কোথায়? ভাইবোনেরা কোথায়? দোতলায় সবাই কাঁদছে। আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাই আছে। আমাদের সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। বলা হয়, কারও মৃত্যুর তিন দিনের মধ্যে মানুষ শোক কাটিয়ে ওঠে। কিন্তু আমরা ৪০ দিনেও শোক কাটাতে পারলাম না। আমরা অনুভব করতে শুরু করি, বাবা ছিলেন আমাদের বটবৃক্ষ। সেই বটবৃক্ষকে আমরা হারিয়েছি। তাঁর নির্মল ছায়া আর কোনো দিন পাব না। বাবার মৃত্যুতে ছোট ভাইবোনেরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। সেই কঠিন সময়ে মা নিজের সব দুঃখ চাপা দিয়ে আমাদের স্বাভাবিক করে তুললেন। বাবাকে হারানোর আজ ৩৪ বছর পার হলো। আজ চার বছর হলো আমাদের মা-ও এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।

বাবার মৃত্যুর পর আমার মা খুব শক্তভাবে সংসারের হাল ধরলেন। বাবার আদর্শে আমাদের ছয় ভাইবোনকে গড়তে লাগলেন। ওই ঘটনায় মামলা হয়েছিল। বাবা তেমন অর্থকড়িও রেখে যাননি যে তা দিয়ে আমরা কিছু একটা করতে পারি। জায়গাজমি বিক্রি করে সংসার চালানো, মামলা পরিচালনা করছেন মা। একদিন মামলার রায় হলো। ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। ফাঁসি হওয়ার কথা। কিন্তু হলো না। স্বৈরাচারী এরশাদের সাধারণ ক্ষমায় খুনিরা ছাড়া পেয়ে গেল।

বাবার মৃত্যুর প্রায় ১২ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। জাতির পিতার কন্যা কখনো ভুলে যাননি, দুঃসময়ে কারা তাঁর পাশে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে আমার বাবা ময়েজউদ্দিন অন্যতম। এ কারণে তিনি আমার মাকে সংসদ সদস্য হওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু আমার মা তাঁর কথা রাখতে পারেননি। তিনি সবিনয়ে জানিয়েছেন, এই বয়সে এত বড় গুরুদায়িত্ব পালন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। দায়িত্ব নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। দায়িত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে কাজ করতে হবে। মায়ের এই অপারগতার কারণে আমাকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে বসার সুযোগ করে দেন প্রধানমন্ত্রী। আমি মনে করি, বাবার যে দেশপ্রেম ছিল, তারই পুরস্কার আমি পেয়েছি। সেই ১৯৯৬ থেকে ২০১৮—রাজনীতির মাঠে দীর্ঘ ২২টি বছর পার করলাম। কখনো পিছু হটিনি। সময়ে-দুঃসময়ে দলের সঙ্গে থেকেছি। ২০০৮ সালে সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ এল। সেখানেও আমি এমপি নির্বাচিত হলাম। ২০১৪ সালে আবার নির্বাচনে জেতা। আজ কেবিনেটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে সংযুক্ত হলেই বাবার কথা মনে হয়। মনে হয় তিনি যেন দূর থেকে আমার এসব কাজে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছেন।

আমার বাবা বলতেন, গাজীপুর-নরসিংদী পাশাপাশি হলেও যোগাযোগে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। নৌকা ছাড়া যাতায়াত করা যায় না। এখানে যদি একটা ব্রিজ করা যায়, তাহলে এ অঞ্চলের মানুষ ভোগান্তির হাত থেকে বেঁচে যায়। আমার সৌভাগ্য, ১৯৯৬ সালে এমপি হয়ে বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি। এখন শহীদ ময়েজউদ্দিন সেতু হয়ে এই অঞ্চলের মানুষ চলাচল করে। বাবা কালীগঞ্জকে সুন্দরভাবে সাজাতে চাইতেন। দুস্থ মহিলাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার কথা ভাবতেন। মাতৃমৃত্যু রোধে কালীগঞ্জে ৩টি মাতৃসদন স্থাপন করেছেন তিনি। বেকার যুবকদের স্বাবলম্বী করতে চারতলা প্রশিক্ষণ ভবন নির্মাণ করেছেন। শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি নারীর শিক্ষা নিয়ে ভাবতেন। পরিবার পরিকল্পনা, সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে ভাবতেন। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু কীভাবে কমানো যায়, এ নিয়েও তাঁর বিস্তর চিন্তা ছিল। আমার আরও সৌভাগ্য যে, আমার বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো আমার সময়ে এসে সম্পন্ন করতে পারছি। ছয়তলা ট্রেনিং সেন্টার করেছি। সেখানে মেয়েরা বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

বাবা বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকে সারা জীবন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। সপরিবার বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে আওয়ামী লীগের দুঃসময়েও আমার বাবা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে আমাদের ৭ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী লেনের বাসায় গোপনে বৈঠক করেছেন। তৎকালীন ছাত্রলীগকে সহযোগিতা দিয়েছেন।

আজ আমার বাবার মৃত্যুদিনে তাঁকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

মেহের আফরোজ চুমকি: সংসদ সদস্য এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী