আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে

রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান না হলে বাংলাদেশের সামাজিক ও অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবেই হুমকির মুখে পড়বে
রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান না হলে বাংলাদেশের সামাজিক ও অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবেই হুমকির মুখে পড়বে

কয়েক দিন আগে (২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮) ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডি’ নামের বেসরকারি থিংক ট্যাংক আয়োজিত সেমিনারে যোগ দিয়েছিলাম। আমন্ত্রিত অতিথির মধ্যে ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দাতব্য সংস্থার অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। আলোচ্য বিষয়টির শিরোনাম ছিল, ‘দ্য প্লাইট অব ফোর্সিবাল ডিসপ্ল্যাসড মিয়ানমার ন্যাশনালস (রোহিঙ্গা): মিজারি কন্টিনিউস’ (মিয়ানমারের জোরপূর্বক উৎখাত করা নাগরিকদের দুরবস্থা: চলমান দুর্দশা)। স্মরণযোগ্য যে এক বছরের কিছু ওপরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নির্মম অত্যাচার করে ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে উত্তর আরাকানের রাখাইন অঞ্চলের প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করে বাস্তুচ্যুত করেছিল। সেই থেকে বাংলাদেশ নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিককে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এত বড় জনগোষ্ঠীকে অত্যন্ত স্বল্প জায়গায় এবং ঘনবসতি অঞ্চলে জায়গা দেওয়া একধরনের দুঃস্বপ্নের মতো। তথাপি বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ তাদের জায়গা দিয়েছে এই আশায়, হয়তো অতিসত্বর মিয়ানমার এই সমস্যার সমাধান করবে। বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সমাধানকল্পে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পথ ধরেছিল এবং তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সম্ভবত ভালো করেই উপলব্ধি করেছে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, প্রকৃতপক্ষে যাদের হাতে ক্ষমতা, তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কোনো আলোচনা তেমন ফল দিচ্ছে না। মিয়ানমারের অতীত সামরিক সরকার বা সামরিক বাহিনী সমর্থিত বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত কোনো বিষয়েই দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধানের ধারেকাছেও যায়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক চাপেও খুব একটা সাড়া দেয়নি।

প্রায় ৩০ বছর একঘরে থাকার পর শুধু অর্থনৈতিক কারণেই একধরনের গণতন্ত্রের নিজস্ব সংজ্ঞায় আন্তর্জাতিকভাবে নন্দিত অং সান সু চিকে সরকার গঠনের জায়গা দিয়েও ক্ষমতা হাতে রেখে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন বা আরাকানের রোহিঙ্গাদের উৎখাত অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং বহুদিনের পরিকল্পনা। কাজেই ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের যেভাবে উৎখাত করা হয়েছে, তা ছিল বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ, এবং তা অং সান সু চির না জানার কথা নয়।

বাংলাদেশের প্রচেষ্টা ক্রমেই আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গা বিষয়ে নাড়া দিয়েছে—সন্দেহ নেই। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে ভারত, চীন ও রাশিয়া ছাড়া পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। কানাডার পার্লামেন্ট রোহিঙ্গা নিধনকে গণহত্যা আখ্যা দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর তেমন চাপ প্রয়োগ করতে পারেনি; অন্তত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ফেরত পাঠানোর মতো তেমন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারেনি এবং পারবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান বলেছেন, কোনো সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাতিসংঘ চাপ প্রয়োগ করতে পারে না। বোঝা যাচ্ছে জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দুই দেশ রাশিয়া ও চীন এবং ভারতের সমর্থন যত দিন পর্যন্ত রয়েছে, তত দিন মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনী বাইরের কোনো চাপই বিবেচনায় নেবে না।

বাস্তবতা বলছে, রোহিঙ্গা সমস্যা সহজে সমাধান হচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আপাতত সীমান্তঘেঁষা কক্সবাজার এলাকায় রাখতে হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরে ১ থেকে ১৮ বছর বয়সী এতিম অথবা পরিবারের সঙ্গে আশ্রয় নেওয়া তরুণের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারের কাছাকাছি বলে ধারণা করা হয়। এসব শিশু একটি বদ্ধ পরিবেশে বেড়ে উঠবে এবং তারা লোমহর্ষক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশছাড়া হয়েছে। এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব তাদের ওপর পড়বে। ১৮ থেকে ৩৫ বয়সীদের মধ্যেও প্রভাবটি প্রবলভাবেই বিরাজ করবে। ভবিষ্যতে এই জনগোষ্ঠী ওই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হতে পারে।

রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান না হলে বাংলাদেশের সামাজিক ও অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবেই হুমকির মুখে পড়বে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আগামী দু–এক বছরের মধ্যে না হলে ৫ থেকে ১০ বছরে ওই অঞ্চলের আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে; যা ভারত ও চীনের বিশাল বিনিয়োগের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, এ ধরনের উদ্বাস্তু ক্যাম্প বা আশ্রয়শিবিরগুলোই সচরাচর আন্তর্জাতিক জঙ্গি তৎপরতা অথবা তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়। ইতিমধ্যেই একিউআইএস (আল-কায়েদা ইন সাউথ এশিয়া) তৎপর রয়েছে বলে সময়ে সময়ে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত হয়ে আসছে। আল-কায়েদার বর্তমান কৌশলের প্রথম ধাপ হচ্ছে অতি অল্প বয়সীদের মধ্য থেকে সদস্য সংগ্রহ। এবং সে জন্য তারা প্রয়োজনে পরিবারকেও উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়। রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হলেও নিজের ভিটায় ফেরার স্বপ্ন তাদের থাকবেই। ফলে আরাকানে যেসব দেশ বিনিয়োগ করবে, তাদের লগ্নি হুমকিমুক্ত না–ও হতে পারে। সম্ভবত এসব বিবেচনায় নিয়েই মিয়ানমার সরকার বুথিডং ও মংডু এলাকায় রোহিঙ্গাদের ছেড়ে আসা ভিটেমাটিতে সৈনিক ছাউনি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা যদি দীর্ঘায়িত হয়, সে ক্ষেত্রে শুধু সামাজিক নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা নয়; বরং ওই অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ পার্বত্য চট্টগ্রামে, যার রাখাইন প্রদেশের সঙ্গে সীমানা রয়েছে, পরিবেশও অশান্ত হয়ে উঠতে পারে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ যে মিয়ানমার রাখাইন অঞ্চলের রাখাইন গোত্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) দক্ষিণ পার্বত্য অঞ্চলের বিশেষ গোত্রের যুবকদের স্বাধীন রাখাইন রাজ্য গড়তে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে অনুরোধ করেছে। রোহিঙ্গা অথবা তথাকথিত আরসার (এআরএসএ) সঙ্গে আরাকান আর্মির কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে তারা ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রসঙ্গত, আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত অন্যান্য গোষ্ঠীর মাদক ব্যবসার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের একাংশ জড়িত ছিল, যা এখনো রয়েছে। রোহিঙ্গাশূন্য এলাকায় আরাকান আর্মির আনাগোনা বেড়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। ২০১৮ সালের মে মাসে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তুমুল লড়াইয়ের জেরে উত্তর রাখাইন অঞ্চলে কয়েক হাজার রাখাইন বুড্ডিস্ট উদ্বাস্তু ভারতের মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল, যাদের ফেরত পাঠাতে ভারত ও মিয়ানমার সহযোগিতা করছে। অথচ রোহিঙ্গারা তাদের ধর্ম আর আঞ্চলিক ভাষার কারণে বাংলাদেশি বা বাঙালি হিসেবে বাস্তুহারা হয়েছে। যা হোক, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যত দিন ক্ষমতার রশি ধরে থাকবে, তত দিন রোহিঙ্গা ইস্যুর গ্রহণযোগ্য সমাধান হবে বলে মনে হয় না।

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের কাছে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা এবং বিশ্বজনমত গঠন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু একটি জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়া রোধের দায় বিশ্ববাসী কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না। সে দায় কূটনৈতিকভাবে মোচন না করতে পারলে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা করার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা বিষয় এবং বাংলাদেশের বাস্তবতার চিত্রই তুলে ধরেছেন এবং অত্যন্ত বাস্তবধর্মী তিনটি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। গত অধিবেশনেও তিনি পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন; যা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়েছে। বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ এবং স্থায়ী সমাধান আশা করে, যাতে এই দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক জোরালো হতে পারে।

তবে জোরালো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান অচিরেই না হলে বাংলাদেশের একটি অংশ এবং সামগ্রিকভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই বিষয়টি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর অনুধাবন করা উচিত। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সমাধানে বিশ্বাস রাখছে। দেশটি রোহিঙ্গাদের নিজ ভিটেমাটিতে পুনর্বাসন ও মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধান আশা করে।

 এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক