প্রাক্-নির্বাচনী জনসভা গণতন্ত্রের অংশ

ছিটেফোঁটা গণতন্ত্র আছে, এমন দেশগুলোতেও প্রচুর জনসভা হয়। এমনকি গণতন্ত্রহীন ভূখণ্ডেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনসভা দরকার। জনসভা থেকে উত্থাপিত হয় গণতন্ত্রের দাবি। ব্রিটিশ আমলে বিদেশি আমলাতান্ত্রিক শাসনেও জনসভা হয়েছে। উচ্চারিত হয়েছে পরাধীনতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং স্বশাসন বা স্বাধীনতার দাবি। গান্ধীজিসহ অগণিত নেতা অসংখ্য জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। এ দেশে উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং গত শতাব্দীর প্রথম দশকে বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলনের সময় অনেক জনসভা হয়েছে। ১৯০৪ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় মহকুমা ও জেলা শহরগুলোতে বড় বড় জনসভা হয়েছে। ঢাকায় জগন্নাথ কলেজের মাঠে, ভিক্টোরিয়া পার্কে ও সদরঘাটে দু-চার দিন পরপরই জনসভা হয়েছে। 

তখন পরাধীন ছিল দেশ, শাসক-প্রশাসক বিদেশি, জেলা ও মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট হয় ইংরেজ নয় আইরিশ, নয়তো স্কট। তখনো ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর চত্বরে অথবা থানার বারান্দায় গিয়ে জনসভার জন্য বিরোধী নেতাদের করজোড়ে প্রার্থনা করতে হয়নি। জনসভা হয়েছে। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন নেতারা। পদাঘাত করেছেন মঞ্চে। পাগড়ি পরা পুলিশ দূরে কোনো গাছতলায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। সাদাপোশাকের বিশেষ শাখার লোক এদিক-ওদিক বসে বা দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তৃতার নোট নিয়েছেন। 

সেকালের জনসভায় যে নেতা বক্তৃতায় সীমা লঙ্ঘন করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। পুলিশ সকালে গিয়ে তাঁকে সসম্মানে গ্রেপ্তার করেছে। মধ্যরাতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে চোখ বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গাড়িতে তোলেনি। ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। সেই ঐতিহ্য পাকিস্তানি আমল পর্যন্ত ছিল। কাগজ দেখিয়ে পুলিশ অফিসার বলতেন, স্যার, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। থানায় দীর্ঘ সময় রাখা হতো না। দ্রুত আদালতে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হতো। উকিল-মোক্তার জামিনের ব্যবস্থা করতেন। রিমান্ড বলে যে কোনো শব্দ আছে, তা গত শতাব্দী পর্যন্ত এ দেশের উচ্চশিক্ষিত লোকজনেরও জানা ছিল না। এখন এসব ভাবাই যায় না। 

ঈদের জামায়াতের জন্য যেমন ঈদগাহ দরকার, তেমনই জনসভার জন্য মাঠ প্রয়োজন। অনেক দেশেই জনসভার জন্য নির্দিষ্ট ময়দান আছে। লন্ডনে হাইড পার্ক ও ট্রাফালগার স্কয়ারে গিয়ে যে কেউ গলা ফাটাতে পারেন। কোনো পারমিশনের প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রীর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করলেও কোমরে দড়ি ও হাতে হ্যান্ডকাফ পরার আশঙ্কা নেই। 

জনসভা করেই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ শাসকদের বিতাড়িত করা গেছে। জনসভা ছাড়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করার সাধ্যি ছিল না মুহম্মদ আলী জিন্নাহর। জনসভা ছাড়া বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা সম্ভব ছিল না। জনসভা করা না গেলে চুয়ান্ন সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হতে পারত না, এবং মুসলিম লীগের কফিনে পেরেক ঠোকা যেত না। জনসভা ছাড়া আইয়ুব শাহির পতন ঘটানো সম্ভব হতো না। জনসভা থেকেই বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। 

শুধু বাংলাদেশে নয়, যুগে যুগে দেশে দেশে জনসভা থেকে এমন দু-একটি কথা ধ্বনিত হয়েছে, যা তৈরি করেছে ইতিহাস। জনসভা থেকেই আব্রাহাম লিঙ্কন উচ্চারণ করেন তাঁর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। জনসভা থেকেই মার্টিন লুথার কিং প্রকাশ করেন তাঁর আকাঙ্ক্ষা: ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’—আমার একটি স্বপ্ন আছে। জনসভা থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বলেন, ‘আপনারা আমাকে রক্ত দিন, আমি আপনাদের স্বাধীনতা এনে দেব’। তিয়েনআনমেন স্কয়ারের জনসভাতেই মাও ঝে দোঙ উচ্চারণ করেন, ‘চায়না স্টুড আপ’—চীন উঠে দাঁড়িয়েছে। 

জনতার নিজস্ব বিচার-বিবেচনা আছে। জনগণ স্বাধীন। জনতা কোনো নেতার গোলাম নয় যে নেতা যা বলবেন জনতা তাতেই সায় দেবে। সে জন্যই অদ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা যখন রেসকোর্স ময়দানে দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ শ্যাল বি উর্দু অ্যান্ড উর্দু, অ্যান্ড নো আদার ল্যাঙ্গুয়েজ, তখন ময়দান থেকে ধ্বনিত হয় ‘নো’, ‘নো’, ‘নো’। জনসভায় নেতাই সব নন—জনতাই আসল। 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বৃহত্তম জনসভা হয় আরমানিটোলা মাঠে আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে। প্রধান বক্তা ছিলেন দলের সভাপতি ভাসানী। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বড় বড় জনসভা হয়েছে প্রথমে আরমানিটোলা মাঠে ও পরে পল্টন ময়দানে। সেকালে কোনো কোনো জনসভায় মারামারি হয়েছে। পুলিশের হান্টারের বাড়ি পিঠে পড়লে বিরোধীরা তা বিশেষ অগৌরবের মনে করেন না। প্রতিপক্ষ দলের লোকের হাতে মার খেলে সে ব্যথা সহজে সারে না। 

পঞ্চাশের দশকে ঢাকা নগরী ছিল ছোট। লোকসংখ্যা ছিল কম। দলের নেতাদের পকেটও ছিল ফাঁকা। জনসভা করার দু-তিন দিন আগে থেকে কানেস্তারা টিন পিটিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোষণা দেওয়া হতো: অমুক দিন পল্টন ময়দানে বিরাট জনসভা। দলে দলে যোগ দিন। যাঁদের একটু অবস্থা ভালো, তাঁরা রিকশায় মাইক থেকে ঘোষণা দিতেন: ‘ভাইসব, একটি ঘোষণা। আগামী রবিবার বিকেল ৩টায় পল্টন ময়দানে অমুক দলের বি-রা-ট জনসভা। দলে দলে যোগ দিন।’ সে রকম দলের জনসভা হলে মানুষ দুপুরের খাওয়া একটু আগেই সেরে নিত। পায়ে হেঁটে জনসভায় যোগ দিত। আবার এমন দলেরও ‘বিরাট’ জনসভা হয়েছে, যেখানে জনসমাবেশ হয়েছে দু-আড়াই শ লোকের। 

ষাটের দশকের শেষ দিকে পল্টন ময়দানের বাইরে বড় সমাবেশের জন্য চালু হয় রেসকোর্স বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। অন্য শহরগুলোতেও বড় জনসভার জন্য নির্দিষ্ট স্থান ছিল, যেমন খুলনায় হাদিস পার্ক, চট্টগ্রামে লালদীঘি ময়দান, রাজশাহীতে জেলখানার মাঠ। স্বাধীনতার পরে খুব বড় কয়েকটি জনসভা হয়েছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে। 

কয়েক বছর যাবৎ সরকারি দলের এবং বিরোধী দলের জনসভাকে ঘিরে আজব ব্যাপার শুরু হয়েছে। সরকারি দলের জনসভাকে ‘সাফল্যমণ্ডিত’ করতে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র এক পায়ে খাড়া। দূরপাল্লার বাস, ট্রেন, লঞ্চ আনুকূল্য দিতে সানন্দে এগিয়ে আসে। বিরোধী দল জনসভার তারিখ ও স্থান ঘোষণা করা মাত্র সরকারি দলের নেতারা হাহাকার করতে থাকেন। দেশবাসীকে জানিয়ে দেওয়া হয় ‘নাশকতা’ হবে। পুলিশ ও প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে বিরোধী নেতাদের জুতার শুকতলি শেষ। যদি তাঁরা চান শুক্রবারে জনসভা করতে, ওদিন দেওয়া যাবে না। যদি অনুমতি চান বিষ্যুদবারের জন্য, পুলিশ বলেন শুক্রবারে করেন। কয়েক দিন পানি ঘোলা করার পর বিচিত্র শর্তে অনুমতি দেওয়া হয়। ওই সব শর্ত মেনে জনসভা করা নাকে খত দেওয়ার শামিল। 

এই প্রবণতা গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বরখেলাপ এবং সাংবিধানিক অধিকারকে অসম্মান করা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় নারকীয় হামলা হয়েছে। তাতে ক্ষমতাসীনদের কারও কারও মদদ ছিল। সিপিবির পল্টনের জনসভায় বোমা হামলায় মানুষ মারা গেছে। তা ছাড়া, বিরোধী দলের সব বড় বড় জনসভাই শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। বিরোধী দল জনসভা করতে চাইলেই সরকারি দলের নেতাদের কথাবার্তায় নার্ভাসনেসের প্রকাশ ঘটা বিরক্তিকর। 

আগের দিনে জনসভার কাজ ছিল মত প্রকাশ ও জনমত গঠন। এখন জনসভার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা বহুমাত্রিক। কয়েক দিন আগে এক সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সরকার এত আইন করছে, কিন্তু গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসছে না কেন? পুলিশের অভিযোগ, মালিক-শ্রমিক আইন মানছেন না। মূল কারণ কী? 

আমি বলেছি, মূল কারণ আর কিছুই নয়—জনসভা। বাসমালিকদের কাছে সরকার ঋণী। যেদিন সরকারি দল ঢাকায় জনসভা করে, সেদিন তাঁরা বিনা ভাড়ায় ঢাকার বাইরে থেকে লোক আনেন। যেদিন বিরোধী দল জনসভা করে, সেদিন ঢাকার ভেতরে এবং বাইরের বাস সকাল থেকে বন্ধ থাকে। পরিবহনশ্রমিক ও মালিকদের অঘোষিত ধর্মঘট। এরপর বাসের মালিক-শ্রমিক আইন মানতে পারেন না, সড়কে যত খুশি মানুষ মারতে পারেন। 

জনসভায় বাধা দেওয়া গণতন্ত্রের বুকে ছুরিকাঘাত। গণতান্ত্রিক অধিকার শুধু ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়া বা না-দেওয়া নয়। প্রাক্-নির্বাচনী জনসভা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক