দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করুন

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সংলাপের সময় ব্যাংক ঋণখেলাপি সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঋণখেলাপিদের ‘নির্লজ্জ’ আখ্যা দিয়ে তাঁর একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, ‘অনেক আগে একজন ঋণখেলাপিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না কেন? জবাব ছিল, ঋণ পেতে তাঁর অনেক জুতা ক্ষয় হয়েছে। তাই তিনি পরিশোধ করবেন না।’

২৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় এই খবরটি পড়ে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হলো, এ রকম নিঃসংকোচ স্পর্ধিত জবাব যারা দিতে পারে, তারা যে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু সরকার মহাপ্রতাপশালী ঋণখেলাপিদের দম্ভ মেনে নিচ্ছে কেন? এ প্রসঙ্গে ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত অর্থমন্ত্রীর একটি উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক কারণেই খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি
উৎসাহিত হয়েছে।’

আমি বরাবর বলে চলেছি, খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেওয়া হয় তা প্রকৃত হিসাব নয়। কেননা এর মধ্যে অবলোপন (রাইট অফ) করা ঋণের হিসাব থাকে না। অবলোপন করা মন্দ ঋণের সুদ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। তাই সুদ-আসলে মন্দ ঋণ বাড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অবলোপন করা ঋণের সুদাসলে হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলো গোপন রাখে কেন?

প্রকৃত হিসাবটা জানা গেলে থলের বিড়ালটা বেরিয়ে যেত: শুধু অবলোপন করা খেলাপি ঋণের সুদাসলে বর্তমান স্থিতি দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর নানাভাবে বারবার রিশিডিউলিং করে এবং নতুন ঋণের মাধ্যমে মন্দ ঋণ অ্যাডজাস্ট করে ক্লাসিফায়েড ঋণের পরিমাণ কমানোর বিষয়টা বিবেচনায় নিলে বোঝা যাবে, খেলাপি ঋণ সমস্যা এখন মহাসংকটে পরিণত হয়েছে।

আমার দৃঢ় ধারণা, অবলোপন করা ঋণের প্রকৃত হিসাব প্রকাশিত খেলাপি ঋণের হিসাবের সঙ্গে যোগ করলে দেখা যাবে, দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ, খেলাপি ঋণ সমস্যাটা অনেক বেশি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে অনেক আগেই। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ এই সত্য গোপন রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। তারা চায় না জনগণ এটা জানুক।

বেশির ভাগ ব্যাংকই তাদের অবলোপনকৃত মন্দ ঋণের এক শতাংশও আদায় করতে পারেনি বলে খবর রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিদের স্বজ্ঞান নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা কিংবা সুপরিকল্পিত যোগসাজশে দেশের কয়েক হাজার রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি কর্তৃক নানাভাবে খেলাপি ঋণ হজম করে ফেলার ব্যাপারটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

ঋণ রাইট অফ করা মানে তো ঋণ মাফ করে দেওয়া নয়, শুধু ব্যাংকের মূল ব্যালান্সশিট থেকে সরিয়ে আলাদা আরেকটি লেজারে মন্দ ঋণের হিসাব সংরক্ষণ করা। তাই পুরো ব্যাপারটায় বড় ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতির আভাস আছে। এভাবে সমস্যাটাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলা কি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা নয়? অথচ, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে, মালয়েশিয়ায় এমনকি পাকিস্তানেও অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ আদায়ের নজির সৃষ্টি হয়েছে।

২০০০ সালে মাহাথির মোহাম্মদের শাসনাধীন মালয়েশিয়ায় ঋণের সহজামানত হিসেবে ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেওয়া এক গাড়ির মালিককে রাস্তায় চলন্ত অবস্থায় থামিয়ে গাড়িটা জব্দ করা হয়েছিল। পাকিস্তানে পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় এসে ঋণখেলাপিদের এমন গণহারে গ্রেপ্তার শুরু করেছিলেন যে ওই এক ধাওয়াতেই পাকিস্তানের খেলাপি ঋণ সমস্যা নাটকীয়ভাবে কমে গিয়েছিল। আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে যে খেলাপি ঋণ সমস্যার নিরসন হয়, তার দুটো সফল উদাহরণ এই দুটো ঘটনা।

আমি ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ডেপুটেশনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়া সংসদে ২ হাজার ১১৭ জন কোটিপতি ঋণখেলাপির যে তালিকা প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্য থেকে দৈব চয়নের মাধ্যমে ১২৫টি নমুনা নিয়ে আমি ও আমার তিন সহকর্মী খেলাপি ঋণের ওপর একটি গবেষণা করি। সেই গবেষণার প্রাথমিক ফল ১৯৯৯ সালে একটি জাতীয় সেমিনারে উপস্থাপন করা হলে দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে আমাদের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে খেলাপি ঋণ সমস্যাকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তুলাধোনা করেছিলেন।

কিন্তু ওই সেমিনারের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর আমাদের সহায়তা করেননি। আমাদের গবেষণা পদ্ধতি পরিবর্তন করে কেস স্টাডির সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিতে হয়েছিল। ফলে ওই গবেষণায় দেশের ৩১ জন শীর্ষ ঋণখেলাপির কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে। ওই রিপোর্টটির প্রকাশনাও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু রিপোর্টটি ২০১০ সালে এ প্রোফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ নামের বই হিসেবে প্রকাশ করেছি। বইটির সপ্তম অধ্যায়ে ওই ৩১ জন রাঘববোয়াল ঋণখেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোকে দেশের বরেণ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনিসুর রহমান ‘হেয়ার রেইজিং স্টোরিজ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম খেলাপি ঋণ সমস্যাটি গোপন রাখার প্রবণতা এ দেশের ব্যাংক খাতের উচ্চতম পর্যায়ে গেড়ে বসে থাকার কাহিনিটা উদ্‌ঘাটনের উদ্দেশ্যে। প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশজন ঋণখেলাপিকে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছিলাম। সে জন্য ১৯৯৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন আহমদের ‘নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচারে’র একটি সুপারিশ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছিলাম; সে লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছিলাম। কারণ, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের বিত্ত ও ক্ষমতার কাছে অর্থঋণ আদালতগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এক সেমিনারে অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, দেউলিয়া আইন পাস হলে ঋণখেলাপিদের শায়েস্তা করা যাবে। দেউলিয়া আইন পাস হওয়ার পর প্রথম দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। তিনি তৎক্ষণাৎ আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসার ঘোষণা দেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আর ওই ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর তাদের আমলে দেউলিয়া আদালতে একটি মামলারও রায় হয়নি। অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমেও ঋণখেলাপিদের শাস্তি প্রদান অসম্ভব প্রমাণিত হচ্ছে মহাশক্তিধর রাঘববোয়াল খেলাপিদের অর্থবিত্ত ও উচ্চ আদালতের আপিলের অবিশ্বাস্য দীর্ঘসূত্রতার কারণে। অথচ তাঁরা দিব্যি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নতুন নতুন ঋণ পাচ্ছেন। তাঁরা খেলাপি ঋণের সিংহভাগই বিদেশে পাচার করে চলেছেন।

২০০৯ সালের পর থকে গত ৯ বছরে এহেন দেশদ্রোহমূলক অপরাধ দমনের কোনো ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব প্রধান প্রতিবন্ধক, এ কারণে অর্থমন্ত্রীও এর কোনো প্রতিকার করতে পারেননি। এহেন জ্ঞানপাপীসুলভ নিষ্ক্রিয়তার জন্য একদিন তাঁদের ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সরকার ব্যাংকমালিকদের একের পর এক অন্যায় সুবিধা দিয়ে চলেছে। অতি ধনীর ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লজ্জাজনক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এনে দিয়েছে বাংলাদেশকে।

কিছু লোককে সীমাহীন অর্থবিত্তের মালিক হওয়া এবং বিদেশে অর্থ পাচার করার সুযোগ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের
বিচার ও শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশজন ঋণখেলাপিকে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করার জন্য সংসদের শেষ অধিবেশনে ‘ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল’ বিল পেশ করে পাস করার ব্যবস্থা করুন।

ড. মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক