ট্রাম্প-উন আলোচনা এগিয়ে নিচ্ছেন মুন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন

সিঙ্গাপুরে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠকের পর কয়েক মাস দুই দেশের মধ্যে দৃশ্যমান কোনো যোগাযোগ ছিল না। সম্প্রতি উভয় পক্ষ আবার একটু নড়েচড়ে উঠেছে। গত আগস্ট মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর উত্তর কোরিয়া সফর করার কথা ছিল। কিন্তু শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও অচল করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি সেই সফর বাতিল করেন। ট্রাম্পও ওই সময় বলেছিলেন, কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার বিষয়ে উত্তর কোরিয়া আশানুরূপ কিছুই করেনি বলে শান্তি প্রক্রিয়া আর এগোবে কি না, তা নিয়ে তাঁর সন্দেহ আছে।

কিন্তু গত মাসের শেষের দিকে আমরা ওয়াশিংটনের বক্তব্যে নাটকীয় পরিবর্তন দেখলাম। সেখান থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হলো, এ বছরের শেষের দিকে ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো উনের সঙ্গে বসতে পারেন। উনের পাঠানো একটি চিঠিকে তিনি ‘অতি উষ্ণ এবং অতি ইতিবাচক’ বলে অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পের কার্যালয় বলেছে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আরেকটি সম্মেলনের প্রক্রিয়া তারা ইতিমধ্যেই শুরু করেছে। এ ছাড়া কোরীয় যুদ্ধের সময় উত্তর কোরিয়ায় নিহত হওয়া মার্কিন সেনাদের দেহাবশেষ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের যে প্রস্তাব পিয়ংইয়ং দিয়েছে, ওয়াশিংটন তাকে স্বাগত জানিয়েছে।

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের এক ফাঁকে ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে–ইনের সঙ্গে বৈঠক করার পর ওয়াশিংটনের দিক থেকে এ খবর এল। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক দিকে মোড় নেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন মুন জে–ইন। গত মাসের শুরুতে মুন পিয়ংইয়ংয়ে তৃতীয়বারের মতো কিম জং–উনের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সত্তরের দশকে বিশেষ বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মুন জে–ইনের মূল শিকড় উত্তর কোরিয়ায়। কোরীয় যুদ্ধের সময় তাঁর বাবা উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে আসেন। এ কারণে মুন যখন পিয়ংইয়ংয়ে পা রাখেন, তখন বাস্তবিক অর্থেই তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ফলে দুই কোরিয়ার মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য তাঁর বিশেষ আগ্রহ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তিনি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানো এবং পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পিয়ংইয়ং সফরের সময় তাঁর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি দল এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়েছিলেন। অবকাঠামোগত যোগাযোগ এবং যৌথ শিল্প এলাকা গড়ে তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। সমন্বিতভাবে যৌথ মালিকানায় শিল্পকারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধংদেহী মনোভাবকে যথাসম্ভব প্রশমিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উত্তর কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়েই যে কোরীয় উপদ্বীপে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়টিই হয়তো তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারছেন।

মুনের উত্তর কোরিয়া সফরের সময় ‘পিয়ংইয়ং ঘোষণা’ নামের যে সমঝোতা চুক্তি হয়, সেখানে দুই কোরিয়ার অংশীদারত্বে বেশ কিছু প্রকল্প চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা রেলপথ নির্মাণ এবং কায়েসং শিল্প এলাকার পুনরুত্থানের প্রস্তাবও আছে। শুধু তা-ই নয়, ২০৩২ সালে দুই দেশ যৌথভাবে অলিম্পিক গেমসের আয়োজক হতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে বৈরিতা ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া মৈত্রীর দিকে হাত বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পূরণে তাকে খুবই আন্তরিক মনে হচ্ছে।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, উত্তর কোরিয়া তার ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষাস্থল ডংচেংরি নষ্ট করার পরিকল্পনা করেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং সেই পরীক্ষাস্থল আন্তর্জাতিক পরিদর্শক দলকে দেখাতেও রাজি হয়েছে। পাশাপাশি তারা ইয়ংবিওন পরমাণু চুল্লি স্থায়ীভাবে নষ্ট করতেও রাজি হয়েছে। উত্তর কোরিয়াকে এমন নমনীয় জায়গায় নিয়ে আসতেও মুনের ভূমিকা আছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো উনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে ট্রাম্পকে রাজিও করিয়েছিলেন মুন। তিনি ট্রাম্পকে বুঝিয়েছিলেন, উত্তর কোরিয়ায় শান্তি স্থাপনে উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারবেন।

এখন মুনের সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্র যে মাত্রায় উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ দাবি করছে, তা কতখানি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, উত্তর কোরিয়াকে তার পরমাণু কার্যক্রমের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করতে হবে। এ–সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য–উপাত্ত তাদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। তবে সেই দাবি কিম জং–উন মানবেন কি না, তা এক বিরাট প্রশ্ন।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

রিচার্ড জাভেদ হায়দারিয়ান, এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বিষয়াবলির বিশেষজ্ঞ