বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়া কঠিন হবে

>

চলমান রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন নাগরিক সমাজের দুই প্রতিনিধি। তাঁরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবউল্লাহ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল। এখানে ড. মাহবুবউল্লাহর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান। 

প্রথম আলো: রাজনীতিতে নির্বাচনের হাওয়া বইছে। কেমন নির্বাচন হবে বলে মনে করেন?

মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচন নিয়ে দুই ধরনের কথাবার্তা আছে। কেউ বলছেন নির্বাচন হবে। কেউ বলছেন হবে না। তবে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হলো একটি শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো পথে যদি ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, তা কারও জন্য সুখকর হবে না।

প্রথম আলো: বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে?

মাহবুবউল্লাহ: বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। বিএনপিকে নির্বাচন করেই ক্ষমতায় যাওয়ার কথা ভাবতে হবে। কিন্তু তাদের সামনে সমস্যা হলো নির্বাচনের পরিবেশ নেই। গুম, খুন ও মামলা-হামলার ঘটনা ঘটছেই। পত্রিকাগুলো এর নাম দিয়েছে ‘গায়েবি মামলা’। দেশের দুটি প্রধান দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যুদ্ধংদেহী এবং সেটি শাসক দলের পক্ষ থেকেই বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের কথাও সবার জানা। এ অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা দুরূহ।

দ্বিতীয়ত, আমাদের যে রাজনৈতিক ঐতিহ্য তাতে দলীয় প্রধানকে জেলে রেখে নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া মুক্ত না হলে বিএনপির জন্য নির্বাচনে যাওয়া কঠিন হবে। দলের কর্মীরা মানতে চাইবেন না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা যদি মনে করেন আরেকটি একতরফা নির্বাচন করবেন, সেটি হবে হঠকারিতা। অতীতে যাই হোক না কেন, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকেই আলোচনার উদ্যোগ আসা উচিত। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপি যে ৭ দফা দাবি দিয়েছে, সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় ফেব্রুয়ারিতেও আমরা নিশ্চিত ছিলাম না শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হবে। অন্যদেরও। ১৬ ফেব্রুয়ারির জনসভায় মাওলানা ভাসানী যখন ঘোষণা করলেন, ‘বাস্তিল দুর্গ ভাঙার মতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমরা মুজিবকে মুক্ত করে আনব’, তখনই পরিস্থিতি পাল্টে গেল। সর্বত্র ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল। আইয়ুব খানের পতন হলো।

প্রথম আলো: কিন্তু আন্দোলনের সেই পরিস্থিতি কি এখন আছে?

মাহবুবউল্লাহ: পরিস্থিতি নেই। আবার এ-ও সত্য যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৪৪ ধারা জারি না হলে মিছিল-সমাবেশ করতে কোনো বাধা ছিল না। এখন বাধা দেওয়া হচ্ছে। সে সময় আন্দোলনকারীরা অনেক শক্ত কথা বলেছেন; কিন্তু সে জন্য নেতাদের জেলে যেতে হয়নি। এখন যেতে হচ্ছে। বিরোধী দল রাস্তাতেই নামতে পারছে না।

প্রথম আলো: কিন্তু ক্ষমতাসীনদের হাবেভাবে মনে হচ্ছে তাঁরা বিএনপির দাবি মানবেন না। তাঁরা আলোচনাও করতে চাইছেন না।

মাহবুবউল্লাহ: সে ক্ষেত্রে বিএনপির জন্য কঠিন হবে নির্বাচনে যাওয়া। আবার নির্বাচন না করারও বিকল্প নেই। এটি উভয়সংকট। তবে সংকট শুধু বিএনপির নয়। সরকারেরও। তারা একটি ভালো নির্বাচন করতে না পারলে ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি হবে। গণতন্ত্র আরও বিপর্যস্ত হবে। বিশ্বের শক্তিধরদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না, তারা এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইবে। বাংলাদেশের মানুষ সৃজনশীলতা দিয়ে যে পর্যায়ে এসেছে, সেটিকে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না।

প্রথম আলো: বিএনপি ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছিল। তারা বলেছিল এর মাধ্যমে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। ভিশন ২০৩০-এর অন্যতম কারিগর হিসেবে আপনি কি মনে করেন এটি তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে?

মাহবুবউল্লাহ: বিএনপি আমার সহায়তা চেয়েছিল বলে আমি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ বা অন্য দল চাইলেও সেটি করব। ভিশন ২০৩০-এর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে সামনের পথে নিয়ে যাওয়া। ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা থাকায় রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। এটি দেশের জন্য ভালো নয়। একক ক্ষমতা যিনি ভোগ করেন, তাঁর জন্যও কল্যাণকর হয় না। সব বিপর্যয় ও ব্যর্থতার দায় তাঁর ওপরই পড়ে। এ কারণেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। সাংবিধানিক পদসমূহে নিয়োগের জন্য একটি কমিশন গঠন করা যায়; যেখানে সরকারি দলের, বিরোধী দলের এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা থাকবেন। নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পদাধিকারীদের নিয়োগের জন্য এখনো আমরা একটি আইন করতে পারিনি।

প্রথম আলো: নতুন জোট গঠনের একটি প্রক্রিয়া চলছে, যাতে বিএনপির সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?

মাহবুবউল্লাহ: রাজনৈতিক সংকটকালে জোটের রাজনীতি যে খুব কার্যকর ভূমিকা পালন করে, তার প্রমাণ আমরা উনসত্তরে পেয়েছি। সে সময় তিন ছাত্রসংগঠন (ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ ও ছাত্রলীগ) এক না হলে আইয়ুবের পতন হতো না। নব্বইয়ে তিন জোট মিলেই এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটিয়েছিল। সেদিক থেকে নতুন জোটের উদ্যোগকে ইতিবাচক বলে মনে করি।

প্রথম আলো: নতুন জোটের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দেওয়া যাবে না। বিএনপির বাইরে থেকেই প্রধানমন্ত্রী নিতে হবে।

মাহবুবউল্লাহ: মালয়েশিয়ায় এ রকম একটি মডেল দাঁড়িয়েছে। সেখানে আনোয়ার ইব্রাহিম যেহেতু জেলে, তাঁর দল বড় হওয়া সত্ত্বেও মাহাথির মোহাম্মদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তিনি প্রথম দুই বছর এই পদে থাকবেন। এরপর আনোয়ার ইব্রাহিম জেল থেকে ছাড়া পেলে নতুন দায়িত্ব নেবেন। বাংলাদেশের সমস্যা হলো রাষ্ট্রনায়কোচিত চরিত্রের কেউ নেই। বড় রাজনৈতিক নেতা আছেন, জনপ্রিয় নেতা আছেন। রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতারা দৃশ্যত অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু বাংলাদেশে নীতি-আদর্শের চেয়ে দলকে বড় করে দেখা হয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যে দলকেও ছাড় দিতে হয়, সেই মানসিকতা গড়ে ওঠেনি।

প্রথম আলো: কেউ কেউ শর্ত দিয়েছেন, নতুন জোটে আসতে হলে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে হবে।

মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচন শেষ পর্যন্ত ভোটের হিসাব। ২০-দলীয় জোটে বিএনপি ছাড়া জামায়াতেরই নিজস্ব ভোটব্যাংক আছে। তারা নিশ্চয়ই হিসাবনিকাশ করে দেখবে অন্যদের কত ভোট আছে, আর জামায়াতের কত ভোট আছে। একইভাবে আওয়ামী লীগও নানা সমালোচনা সত্ত্বেও এরশাদকে ছাড়ছে না। কেননা, জাতীয় পার্টিরও একটি ভোটব্যাংক আছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের চেয়ে নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের হিসাবটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। বিএনপির জন্য আরেকটি কঠিন পরীক্ষা হলো দলীয় প্রধানকে জেলে রেখে নির্বাচন করা। ভোটের রাজনীতিতে অন্য নেতারা নিজ নিজ আসন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দলীয় প্রধানই অন্যদের আসনে গিয়ে প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার চেষ্টা করেন। বিএনপি যদি নেত্রীর মুক্তির দাবি সামনে এনে নির্বাচনে জয়ী হতে না পারে তখন প্রতিপক্ষ বলবে, ‘জনগণ তাঁর মুক্তি চায় না।’ তবে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকেরা এখন পর্যন্ত যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেটি কিন্তু বিএনপিরই পক্ষেই যায়। তাঁদের মতে, সুষ্ঠু ভোট হলে সরকারি দলের ভরাডুবি হবে।

প্রথম আলো: তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি বদলাবে বলে অনেকে আশা করছেন।

মাহবুবউল্লাহ: সংবিধান অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কথা। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। এই কমিশন গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে, তা ভাবা দুরাশাই বটে। তবে এই দুরাশার মধ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সব প্রক্রিয়ার মধ্যে পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। রেল চলতে হলে লাইন ঠিক থাকতে হয়, গাড়ি চলতে হলে সড়ক মসৃণ থাকা দরকার। কিন্তু সে রকম কোনো লক্ষণ দেখছি না।

প্রথম আলো: বিএনপির ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন কি ভুল ছিল বলে মনে করেন?

মাহবুবউল্লাহ: নির্বাচন বর্জন তারা অতীতেও করেছে। আওয়ামী লীগও করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন এবং ২০১৫ সালে আন্দোলনে বিএনপি যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছে, সেটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে মনে করি। যখন দেখা গেল আন্দোলন সহিংস রূপ নিয়েছে, বিএনপি নেতারা বলছেন ‘এটি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারের ষড়যন্ত্র’, তখন তাঁদের উচিত ছিল কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করা। তাহলে সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচারের সুযোগ পেত না।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মাহবুবউল্লাহ: আপনাকেও ধন্যবাদ।