কাভানার নিয়োগ, সিনহা ও কিছু প্রশ্ন

আমেরিকায় এখন তুমুল আলোচনা হচ্ছে ব্রেট কাভানাকে নিয়ে। তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে মনোনয়ন দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ নিয়ে সিনেটের (আমেরিকার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ) জুডিশিয়াল কমিটিতে শুনানি চলছে। গত সপ্তাহে আমেরিকায় গিয়ে দেখি এই শুনানি দেখছে, শুনছে নানা রঙের বহু মানুষ।

কাভানার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ৩৬ বছর আগে ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি যৌন নির্যাতন করেছিলেন একজন সহপাঠিনীকে। আমরা কেউ হয়তো
বিস্মিত হতে পারি এত বছর আগের বিষয় এমন খুঁটিয়ে দেখা নিয়ে। অথচ এটাই পশ্চিমা দুনিয়া। সেখানে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে যত উঁচু অবস্থানে যায় মানুষ, ততই তার জীবনের আদ্যোপান্ত ইতিহাস নিয়ে চলে নানা অনুসন্ধান।

কাভানার আগে যত বিচারক নিয়োগের প্রস্তাব এসেছে আমেরিকায়, সবার ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট পদে যাঁরা দাঁড়ান, তাঁদের নিয়ে এই অনুসন্ধান আরও তীব্র। সরকারপ্রধান হওয়ার পরও অনেকে রেহাই পান না আমেরিকায় বা বাক্স্বাধীনতার অন্য যেকোনো দেশে। নির্বাচিত হওয়ার পর অভিনেত্রী, ব্যক্তিগত আইনজীবী, সাবেক সহকর্মীদের হাতে যেভাবে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন ট্রাম্প, তা থেকে আমরা এর কিছুটা ধারণা পেতে পারি।

অথচ বাংলাদেশে ঘটে ঠিক তার উল্টো। এখানে যত ক্ষমতাবান হন কেউ, ততই তিনি চলে যান জবাবদিহির ঊর্ধ্বে। তাঁর বিরুদ্ধে সংসদে কেউ কথা বলেন না, সংসদের বাইরে কথা বললে মামলা হয় নানান কিসিমের। আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পান না কেউ, মামলা হলে তিনি জামিন পান বা মামলাই খারিজ হয়ে যায় কখনো।

জবাবদিহি দর্শনের পুরোপুরি উল্টো কাজ চলে আমাদের মতো দেশগুলোতে। এই দর্শনের মূল কথা হচ্ছে যিনি যত বেশি ক্ষমতাবান বা দায়িত্বপূর্ণ পদে যাবেন, তাঁর সম্পর্কে তত বেশি তথ্য জানার অধিকার থাকবে মানুষের। তত বেশি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো (সংসদীয় কমিটি, আদালত, দুর্নীতি দমন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) তাঁর অতীত-বর্তমান সবকিছু পরখ করে দেখবে, প্রয়োজনে তাঁকে অভিযুক্ত করে ব্যবস্থা নেবে। কারণ, তাঁরা খারাপ কাজে অভ্যস্ত হয়েও বড় দায়িত্ব পেয়ে সর্বনাশ করে দিতে পারেন বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর। কাভানার অতীত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে এ কারণেই। কিছু শিক্ষা আমরা নিতে পারি তাঁর কাহিনি থেকে।

২.
আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে এখন আটজন বিচারকের মধ্যে চারজন ডেমোক্রেটিক, চারজন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের চিন্তাধারার। কাভানা নিয়োগ পেলে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সর্বোচ্চ আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে রিপাবলিকান চিন্তাধারার মানুষেরা। অভিবাসন, পরিবেশ ও বিশ্বায়নবিরোধী যেসব আইন বা নীতিমালা করার পরিকল্পনা আছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের, সেগুলো সর্বোচ্চ আদালতে বৈধতা পাওয়ার বড় সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে তখন। কাভানা যদি প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্রের মানুষ হন, তাহলে বিচারক হিসেবে আজীবন নিয়োগকালে তিনি তাঁর দায়িত্বও ঠিকভাবে পালন করবেন না। তাঁর বিচার তাই প্রভাব ফেলতে পারে আমেরিকার, এমনকি পৃথিবীর অন্য বহু এলাকার মানুষের ওপর।

কাভানার অতীত জীবন তাই ঘেঁটে দেখা হচ্ছে আমেরিকায়। তাঁর বিরুদ্ধে সিনেট কমিটিতে ক্রিস্টিন ফোর্ড নামের একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপিকা অভিযোগ করেছেন, ৩৬ বছর আগে তাঁকে ধর্ষণ করার জন্য তাঁর ওপর শারীরিকভাবে চড়াও হয়েছিলেন ‘মাতাল’ কাভানা। এমন একজন মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক হবেন, এটি মেনে নিতে পারছেন না তিনি। এত বছর পর তাই কাভানার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তিনি। কাভানার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ করেছেন আরও দুজন নারী। তাঁর অতীত জীবন তদন্ত করে দেখছে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই–ও।

কাভানা যদি বিচারক হতে আগ্রহী না হতেন, তাহলে হয়তো এসবের কিছুই হতো না। এটি ঠিক, আমেরিকায় সর্বোচ্চ বিচারকদের মনোনয়ন দেন প্রেসিডেন্ট, ১৯৭২ সাল থেকে অনেক ক্ষেত্রে এই মনোনয়নে দলীয় পরিচয়ই রাখে মুখ্য ভূমিকা। কিন্তু তারপরও যাকে খুশি বিচারক পদে নিয়োগ করতে পারেন না প্রেসিডেন্ট দুটো রক্ষাকবচের কারণে। এক. প্রেসিডেন্টের মনোনীত প্রার্থীকে প্রকাশ্য জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার রয়েছে সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির। চাঁছাছোলা এই জিজ্ঞাসাবাদকালে প্রেসিডেন্টের মনোনীত ব্যক্তির অতীত যেকোনো কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন কমিটির (বিশেষ করে বিরোধী দলের) সদস্যরা এবং যেকোনো নাগরিক। ফলে বিচারক পদে মনোনীত কেউ অতীতে অনিয়ম বা অপরাধ করলে তা মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়ে পড়ে, এ জন্য তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহারের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে।

বিচারক পদে নিয়োগে দ্বিতীয় রক্ষাকবচ হচ্ছে সিনেটের ভোটাভুটি। সিনেট কমিটির দেওয়া প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে যে ভোটাভুটি হয়, তাতে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেন যেকোনো সিনেটর। আমাদের মতো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নেই সেখানে, দলের প্রধানের প্রতি অন্ধ আনুগত্যও নেই। ফলে রিপাবলিকানরা সবাই দল বেঁধে কাভানাকে ভোট দেবেন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিনেটে রিপাবলিকান সদস্য ৫১ জন, ডেমোক্র্যাট ৪৯ জন। এর মধ্যে দুজন রিপাবলিকান সিনেটর কাভানার আচরণে রুষ্ট প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁদের একজনও বিপক্ষে ভোট দিলে কাভানা আর বিচারক হতে পারবেন না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিভিন্ন প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডের কারণে আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় আমেরিকান পার্লামেন্টের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানরা কিছু পদ হারাতে পারে। তাহলে ডেমোক্র্যাটরা নিজেদের ভোটেই কাভানার মনোনয়ন ঠেকিয়ে দিতে পারবে। নতুন কাউকে রিপাবলিকানরা মনোনীত করলে তাঁর নিয়োগ নভেম্বরের আগে সম্ভব হবে না। কট্টর কোনো নতুন প্রার্থীকেও তখন ঠেকিয়ে দিতে পারবে ডেমোক্র্যাটরা।

এত কিছুর পরও এফবিআইয়ের তদন্তে গুরুতর কিছু পাওয়া না গেলে, সিনেটে এর মধ্যেই (আজই রয়েছে সেই সম্ভাবনা) ভোট হয়ে গেলে কাভানা হয়ে যেতে পারেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। তিনি বিচারক হয়ে গেলেও সিনেটের শুনানিতে তাঁর সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠার কারণে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকতে হবে তাঁকে। কোনো না কোনোভাবে এই জবাবদিহি কল্যাণকর হবে মানুষের জন্য।

৩.
কাভানার শুনানিকালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে নিয়েও চলছে নানা আলোচনা। তিনি তাঁর বইয়ে গুরুতর কিছু অভিযোগ করেছেন তাঁর পদত্যাগ পর্ব নিয়ে। তাঁর বই প্রকাশের পর তাঁর বিরুদ্ধে সরকার আবারও দুর্নীতি ও অযোগ্যতার অভিযোগ তুলছে। আমার প্রশ্ন: এসব অযোগ্যতা থাকলে তা আগে কেন বিবেচনায় নেওয়া হয়নি? হাইকোর্টে নিয়োগ, এ পদে স্থায়ী হওয়া, আপিল বিভাগে এবং পরে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগকালে অন্তত চারটি পর্বে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ ছিল। কেন দেখা হয়নি? দেখা হয়ে থাকলে কেন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল এত গুরুত্বপূর্ণ পদে?

বিচারকের মতো কেউ দুর্নীতি করলে তাঁর আলামতও থাকে। দুদক বা অন্য কেউ আগে কেন তা কখনো পরীক্ষা করে দেখেনি? এস কে সিনহা
আপিল বিভাগে ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ পেয়েছেন এই সরকারের আমলে। তার বহুদিন পর ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায় প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যে দুর্নীতিবাজ আর অযোগ্য হয়ে গেলেন কীভাবে?

কাভানা আর সিনহাকে নিয়ে এত আলোচনায় একটা অভিন্ন বার্তা রয়েছে। তা হচ্ছে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে এবং সাংবিধানিক পদে নিয়োগে আরও অনেক সতর্ক হতে হবে আমাদের। পাকিস্তানের মতো দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশেও এখন এসব পদে নিয়োগ হয় বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত কমিশনের মাধ্যমে। আমেরিকার মতো যেসব দেশে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন করেন, সেখানে তাঁর অতীত জীবন চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের।

আমাদের দেশে এসব নিয়োগ হয় সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা মোতাবেক। সেই দলও যদি সঠিকভাবে নির্বাচিত না হয়, যদি তার কোনো জবাবদিহি না থাকে কোথাও, তাহলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যথাযথ নিয়োগ কীভাবে সম্ভব হবে?

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক