কার পক্ষ নেবেন তরুণ ভোটাররা?

নির্বাচন কমিশন ভবন
নির্বাচন কমিশন ভবন

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ইয়ুথ বাংলা কালচারাল ফোরাম আয়োজিত অনুষ্ঠানে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য আওয়ামী লীগের সমর্থন বেড়েছে বলে দাবি করেছেন। তাঁর মতে, ২০১৮ সালে এসে বিএনপির ভোট ৩০ শতাংশ আর আওয়ামী লীগের ভোট ৪২ শতাংশ হয়েছে। এ বিষয়ে সমীক্ষা আছে বলেও জানান আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা। কিন্তু তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের যে হিসাব দিয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই।

একজন মাঠের রাজনীতিক কথাগুলো বললে বিস্মিত হতাম না। তাঁরা নেতা-কর্মীদের মনোবল চাঙা রাখতে অনেক কথা বলে থাকেন। কিন্তু এইচ টি ইমাম তো প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের একজন থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত। তাঁর অঙ্ক ভুল হলে দলের নির্বাচনী হিসাবও উল্টে যেতে পারে।

এইচ টি ইমাম বলেছেন, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিএনপির ভোট ৩০ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ দেশের এবং জনগণের উন্নয়ন করার কারণে ভোট বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। অথচ বিগত চারটি নির্বাচনের রেকর্ড ভিন্ন কথা বলে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ভোট পেয়েছিল ৩০.৮ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.১ শতাংশ। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির ভোট কিছুটা হলেও বেশি। ওই নির্বাচনে বিএনপি পায় ১৪০টি আসন, আওয়ামী লীগ ৮৮টি।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪ শতাংশ এবং বিএনপি ৩৩.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের আসন ছিল ১৪৬টি এবং বিএনপির ১১৬টি। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এটাই ছিল তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ ফল। পরবর্তী দুটি নির্বাচনের ফলাফলে দুই দলের আসনে রয়েছে আকাশ-পাতাল ফারাক। যেমন ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১.৪০ শতাংশ ভোট নিয়ে ১৯৩টি আসন পায়। আর আওয়ামী লীগ ৪০.০২ শতাংশ ভোট নিয়ে আসন পায় মাত্র ৬২টি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯.০ শতাংশ ভোট নিয়ে আসন পায় ২৩০টি। অন্যদিকে বিএনপি ৩৩.২ শতাংশ ভোট নিয়ে আসন পায় মাত্র ৩০টি। দুটো নির্বাচনেই ভোটাররা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। এইচ টি ইমামের দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের ভোট যদি বেড়েই থাকে, তাহলে ২০০৮ সালের ৪৯ শতাংশ থেকে ৪২ শতাংশে দাঁড়াল কেন?

উল্লিখিত চারটি নির্বাচনের ময়নাতদন্ত করলে দেখা যাবে, কখনো আওয়ামী লীগ বা কখনো বিএনপি বেশি ভোট পেয়েছে। সব নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ ভোট বেশি পেয়েছে, এইচ টি ইমামের এই তথ্য মোটেই ঠিক নয়। ১৯৯১ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ভোটের ব্যবধান সামান্য হলেও বিএনপিই এগিয়ে ছিল। অন্যদিকে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের থেকে বিএনপি প্রায় ৪ শতাংশ ভোটে পিছিয়ে ছিল। আবার ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের একক নির্বাচনের বিপরীতে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে বিএনপি অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছিল। ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে সামান্য পিছিয়ে ছিল। কিন্তু আসন পায় মাত্র ৬২টি। ২০০৮ সালে ঠিক বিপরীত ঘটনাই ঘটে। বিএনপির আসন নেমে আসে ৩০-এ। এর থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশে ভোট কোনো দলের স্থায়ী আমানত নয়। মানুষ দলের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেন কাজের মূল্যায়ন করে।

২০০১-এর নির্বাচনের পরই আওয়ামী লীগের বোধোদয় ঘটে যে এককভাবে নির্বাচন করে আর জয়ী হওয়া যাবে না। তারা ১৪-দলীয় জোটের পরিসর বাড়িয়ে মহাজোট করে, যার শরিক ছিল এরশাদের জাতীয় পার্টি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, অলি আহমদের এলডিপি। বিএনপির গোঁয়ার্তুমির জন্য ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনটি বানচাল না হলে হয়তো আজ তারা একই ছাতার নিচে থাকত। আওয়ামী লীগের নেতারা এখন যতই তাদের ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির জোট’ বলে বিদ্রূপ করুন না কেন, তখন তারাই ছিল আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী। একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের অঙ্গীকারও করেছিলেন তাঁরা। ২০০৭ সালে নির্বাচনটি হলে ধারণা করি, কোনো দল বা জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেত না এবং আদালতের রায় সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা সম্ভব হতো না। উল্লেখ্য, আদালত সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করতে বলেননি। বলেছিলেন, যদি জনপ্রতিনিধিরা রাজি থাকেন, আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি নেতারা যতই হা-হুতাশ করুন না কেন, এই ব্যবস্থা বাতিলের দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না।      

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে দুর্বল না ভাবা, নেতা-কর্মীতদের আত্মতুষ্টিতে না ভোগার যে সদুপদেশ দিয়েছেন, সেটি তারা কতটা আমলে নেবেন, তার ওপরও নির্বাচনের ফলাফল অনেকটা নির্ভর করবে। আত্মতুষ্টিতে ভুগলে হাতের নাগালে থাকা বিজয় যে কীভাবে হাতছাড়া হয়ে যায়, ১৯৯১ সালের নির্বাচনই তার প্রমাণ। ভোটের আগেই আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ পোর্টফোলিও ভাগাভাগিতে ব্যস্ত ছিলেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

এইচ টি ইমাম বলেছেন, ‘এবারের নির্বাচনে নবীন ভোটার বেশি। এই নবীন ভোটাররা বিএনপি-জামায়াতের অপকর্ম সম্পর্কে জানেন না। এই বিষয়গুলো নবীনদের কাছে পৌঁছাতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে দলের প্রচারের বিষয়ে তিনি আক্রমণাত্মক হতে বলেছেন।’

৩১ জানুয়ারি ২০১৮–এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ১০৫ আর নারী ভোটার ৫ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৬ জন। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটার ছিলেন ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ জন। ২০০৮ সালে ছিলেন ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার। অর্থাৎ গত ১০ বছরে তরুণ ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ। আগামী নির্বাচনে এরাই জয়-পরাজয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। তরুণদের ভোট যঁারা বেশি পাবেন, তঁারা জয়ী হবেন।

এইচ টি ইমাম দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি নতুন ভোটারদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের অপকর্ম তুলে ধরার কথা বলেছেন (জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় তারা দলগতভাবে নির্বাচন করতে পারবে না) কিন্তু বিএনপি ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে দেশে যেসব অনাচার-দুর্নীতি ও গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার দায় বিএনপির ওপর চাপানো যাবে না। অতীতে বিএনপি কী কী অনাচার করেছে, আর বর্তমান সরকারের আমলে কী কী অনাচার হচ্ছে, ভোটাররা সেটাই তুলনা করে দেখবেন। ক্ষমতাসীনেরা আক্রমণাত্মক প্রচার চালিয়ে জয়ী হয়েছে, এমন নজির বাংলাদেশে নেই।

এইচ টি ইমামের কথামতে, এত প্রচার, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও জনসভায় বুলন্দ আওয়াজের পরও যদি নবীন ভোটাররা বিএনপি-জামায়াতের অপকর্ম সম্পর্কে না জানেন, সেটি সরকারের চরম ব্যর্থতা। নির্বাচনী প্রচারে ভোটাররা প্রার্থীদের কাছে অন্যের গিবত শুনতে চান না। তাঁরা দেখতে চান, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধানে সরকার কী করেছে? এই যে নিরাপদ সড়ক নিয়ে এত বড় আন্দোলন হলো, তারপরও কি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে? না এসে থাকলে সেই দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপালে ভোটাররা কি মেনে নেবেন? নেবেন না।

আর নতুন ভোটাররা যা জানতে চাইবেন, তা হলো গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের জীবনমান উন্নয়নে কী ভূমিকা রেখেছে? সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করেছে? সুশাসন প্রতিষ্ঠা কিংবা গুম-খুন, মিথ্যা মামলা বন্ধ হয়েছে কি না? প্রতিবছর যে ২০-২২ লাখ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, সরকার তাঁদের কতজনকে চাকরি দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা বলেছিল, এর কতজন চাকরি পেয়েছেন? যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা কি মেধার জোরে পেয়েছেন, না টাকার বিনিময়ে? তাঁরা জানতে চাইবেন, কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবি জানাতে গিয়ে কতজন তরুণ জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন? সরকার কোটা বাতিল করে তাঁদের দাবির ন্যায্যতাই প্রমাণ করেছে। তারপরও কেন আন্দোলনকারীদের ওপর দফায় দফায় হামলা হলো? কেনইবা আন্দোলনকারীদের জেলে যেতে হলো? তাঁরা জানতে চাইবেন, স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর কেন ছাত্রলীগের কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন? আমরা বিভিন্ন স্থানে দেখেছি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও পুলিশ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিল, কোনো সমস্যা হয়নি।

কিন্তু ছাত্রলীগকে মাঠে নামাতেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গুজব ডালপালা মেলে। দুটো ঘটনাই সরকার অনেকটা হটকারী কায়দায় মোকাবিলা করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা শুধু সড়ক নয়, ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ দাবি তুলেছে। বিএনপির অতীত অপকর্মের ফিরিস্তি
কিংবা উন্নয়নের বয়ান তরুণদের আকৃষ্ট করবে বলে মনে হয় না। নবীন ভোটাররা তাঁদের পক্ষেই রায় দেবেন, যঁারা সত্যিকারভাবেই রাষ্ট্রের মেরামত কাজটি করবেন।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]