খালেদা জিয়ার চিকিৎসা

বিএনপির কারাবন্দী চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু আমরা দেখে আসছি, এটা নিয়ে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চলে আসছে। বিএনপি অভিযোগ করে আসছিল যে সরকার খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আর আওয়ামী লীগের অভিযোগ হলো বিএনপি খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করছে। এই বিরোধাত্মক পরিবেশে খালেদা জিয়া গত জুনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসা গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। কোথায় তাঁর চিকিৎসা হবে, তা নিয়ে একটি অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল। এটা নিয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে যে রাজনৈতিক তর্ক–বিতর্ক হয়েছে, তা অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত ছিল। বিএনপির রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে তিনি অবশেষে বিএসএমএমইউতে চিকিৎসা নিতে সম্মত হয়েছেন—এটা স্বস্তিদায়ক অগ্রগতি।

যে চিকিৎসক নেতারা দলাদলি করে স্বাস্থ্যসেবা অঙ্গনের পেশাদারি সংস্কৃতির ক্ষতির কারণ হচ্ছেন, তাঁদের জন্য আদালতের এই সিদ্ধান্ত শিক্ষণীয় হতে পারে যে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিতব্য চিকিৎসা বোর্ডে তাঁদের কেউ অন্তর্ভুক্ত হবেন না।  

খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় পাঁচ সদস্যের প্রস্তাবিত মেডিকেল বোর্ডের বিষয়ে বিএনপি গতকাল দুজনের বিষয়ে অনাস্থা ব্যক্ত করেছে। তারা বলেছে, হাইকোর্টের রায় অনুসারে যেন বোর্ড গঠন করা হয়। অন্যদিকে বিএসএমএমইউর পরিচালক বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ের ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি যুক্তি দিয়েছেন: সরকার–সমর্থক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বা বিএনপিপন্থীদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) কার্যনির্বাহী কমিটিতে থাকা কেউ সদস্য হবেন না। আমাদের বক্তব্য, হাইকোর্ট যেহেতু একটি ‘নির্দলীয়’ মেডিকেল বোর্ড গঠনের আদেশ দিয়েছেন, তাই এই আদেশের মূল চেতনার আলোকেই বিষয়টির সুষ্ঠু নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। এটা নিয়ে আর কোনো তর্ক–বিতর্ক  না হওয়াই ভালো।

আমরা মনে করি, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা রোগীর চিকিৎসা একান্তই পেশাদারি বিষয়, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ‘নির্দলীয়’ মেডিকেল বোর্ড গঠনের ধারণাটি গোলমেলে। লক্ষ্য যখন রোগীর সুচিকিৎসা, তখন পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। অনাস্থা থাকলে দুই দলের বাইরের লোক রাখাই কোনো মেডিকেল বোর্ডের বিতর্কের ওপরে ওঠার নিশ্চয়তা দেয় না। আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও বিএনপিপন্থীদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলেই কোনো চিকিৎসকের পেশাদারত্ব থাকবে না, তিনি বা তাঁরা কারও চিকিৎসার ক্ষেত্রে দলীয় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবেন—আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকলে তা দুঃখজনক। হাইকোর্ট হয়তো এমন ধারণা থেকেই সরকারের গঠিত মেডিকেল বোর্ডের বাইরে থেকে খালেদা জিয়ার পছন্দমতো চিকিৎসক নিয়োগেরও সুযোগ রেখেছেন। হাইকোর্টের এই আদেশের পর সম্ভবত ভেবে দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে আর দশটি সাধারণ পেশাজীবী গোষ্ঠীর মতো চিকিৎসক সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সমর্থন–ভিত্তিক সংগঠন থাকা উচিত কি না। কেননা, এভাবে আমাদের চিকিৎসক সমাজের পেশাদারত্ব ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

খালেদা জিয়া যদিও একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতা, তবু তাঁর স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টি সব রকম রাজনৈতিক তর্ক–বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকাই বাঞ্ছনীয় ছিল এবং এখনো আছে। এ দিক থেকে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকীর্ণতার ইঙ্গিতবহ। তবে শেষ পর্যন্ত যখন বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গেছে এবং আদালত একটা যথার্থ সমাধান বাতলে দিয়েছেন, তখন আমরা আশা করব, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সরকার বিশ্বস্ততার সঙ্গে খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে।