রাষ্ট্রপতির খেদ ও 'অবসরপ্রাপ্তগণ'

মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ খুব রসিক মানুষ। কথার মাধ্যমে তিনি শ্রোতাদের আনন্দ দেন, হাসান। জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকাকালে তিনি সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদদের হাস্যরসে ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলেন। প্রয়োজনে ভর্ৎসনাও করেছেন। গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বভাবসুলভ রসবোধ দিয়ে আমাদের সমাজ ও রাজনীতির কিছু নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরেছেন, যা পাশ কাটিয়ে যাওয়া অসম্ভব বলে মনে করি।

রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণে প্রেম থেকে প্রেমপত্র লেখা, পুরুষ অধিকার থেকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার (ভারতের প্রখ্যাত অভিনেত্রী) বিয়ে, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার থেকে শিশুর মনস্তত্ত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বোধ সম্পর্কে কথা বলেছেন। এসব কথা হয়তো অদরকারি নয়। কিন্তু সবচেয়ে দরকারি কথাটি বলেছেন রাজনীতি বিষয়ে। ‘গরিবের বউ সকলের ভাবি’ বলে গ্রামাঞ্চলে যে প্রবাদটি আছে, রাষ্ট্রপতি দেশের বর্তমান রাজনীতিকে তার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রবাদটির অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা না দিলেও তিনি এর মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনীতির দীনতা ও চরিত্রহীনতাই বোঝাতে চেয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘রাজনীতি গরিবের ভাউজ, সবাই ইঞ্জিনিয়ার কইন আর ডাক্তারই কইন, এই ভিসি সাবও ৬৫ বছর হইলে কইব, আমিও রাজনীতি করুম। যারা সরকারি চাকরি করে, জজ সাবরা যারা আছে, ৬৭ বছর চাকরি করবো। কইরা রিটায়ার্ড কইরা কইব, “আমিও রাজনীতি করিব”। আর্মির জেনারেল অয়, সেনাপ্রধান অয়, অনেকে রিটায়ারমেন্টে গিয়েই কয়, “আমিও রাজনীতি করিব”। সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি বা জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রত্যেকেই রিটায়ার কইরা বলে, “আমি রাজনীতি করিব”। এটার কোনো রাখঢাক নাই, কোনো নিয়মনীতির বালাই নাই। যে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা, তখনই রাজনীতিতে ঢুকছে। ...এমনকি পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করে। আবার মনে মনে কই, আমরা রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়া কত বাড়ি দিছ। তুমি আবার আমার লগে আইছ রাজনীতি করতা। কই যামু।’

সবশেষে রাষ্ট্রপতিকে আক্ষেপ করতে শুনি: ‘এই যে রাজনীতিবিদদের সমস্যা, এই সমস্যার কারণও এটা। বিজনেসম্যানরা তো আছেই। শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। কী করবেন। এগুলো থামানো দরকার।’

কিন্তু কে থামাবেন?
রাজনীতিক-ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্র এখন একাকার হয়ে গেছে। একটার সঙ্গে আরেকটা ফারাক করা যায় না। ক্ষমতাসীনেরা আওয়ামী লীগকে তৃণমূল থেকে উঠে আসা দল বলে দাবি করেন। প্রতিপক্ষকে সেনানিবাসে তৈরি বলেও গালমন্দ করেন। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম, কেন্দ্রীয় কমিটি, উপদেষ্টামণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলীর দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই দলেও আমলা–ব্যবসায়ীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমান সংসদে যে অর্ধেকের বেশি ব্যবসায়ী আছেন, তাঁরা কেউ বিএনপি থেকে আসেননি। হয় আওয়ামী লীগের অথবা জাতীয় পার্টির। তাহলে সেনানিবাস থেকে উঠে আসা দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পার্থক্য থাকল কোথায়?

রাষ্ট্রপতি বলতে চেয়েছেন সমাজের আর দশটি পেশার মতো অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে রাজনীতিকেও এগিয়ে নিতে হয়। ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে একজন তরুণ নিজেকে ভবিষ্যৎ রাজনীতিক হিসেবে গড়ে তোলেন। আমাদের দেশে যাঁরা বরেণ্য রাজনীতিক, তাঁদের প্রায় সবাই স্কুলজীবনেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করা যায়। বনেদি রাজনীতিকেরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, উপজেলা, জেলা প্রভৃতি স্তর পেরিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এসেছেন। রাজনীতির জন্য তাঁরা অনেক জেল–জুলুম সহ্য করেছেন। ব্যক্তিজীবনের আরাম–আয়েশ ত্যাগ করেছেন। অতীতে বাইরে থেকে কেউ ‘উড়ে এসে জুড়ে বসে’ রাজনীতিতে আসর জমাতে পারেননি। রাষ্ট্রপতি নিজেও তৃণমূল থেকে রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন।

রাজনীতির এই ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটতে থাকে সামরিক শাসকদের হাতে। পাকিস্তানি জমানায় আইয়ুব খান এবং বাংলাদেশ আমলে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে সামরিক-বেসামরিক আমলা, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি, চিকিৎসক, কৃষিবিদদের রাজনীতিতে আসার জোয়ার শুরু হয়। তবে নব্বই–পরবর্তী গণতান্ত্রিক শাসকেরাও রাজনীতিতে বহিরাগতদের আগমন ঠেকানোর চেষ্টা না করে সামরিক শাসকদের রেখে যাওয়া জুতোয় পা ঢুকিয়েছেন। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের ঢের আনাগোনা। আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকদের চাঁদা দিতেন, যাতে তাঁদের স্বার্থের পক্ষে সরকারি নীতি-পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এখন ব্যবসায়ীরা দলে ঢুকে রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করছেন।

রাষ্ট্রপতি সাবেক আমলা কোতোয়ালদের রাজনীতিতে আসা বন্ধের কথা বলেছেন। সব দলকে এ নিয়ে ভাবতে বলেছেন। কিন্তু সরকারি চাকুরেদের অবসরের পর তিন বছর পার না হলে কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে বিধান জারি করা হয়েছিল, সেটি তুলে দিয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই। এর মাধ্যমে সাবেক আমলারা অবসরে যাওয়ার পরদিনই নির্বাচন করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে কেবল জিয়াউর রহমানই রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি কঠিন করেননি; পরবর্তী সব সরকারই সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে চলেছে।

রাষ্ট্রপতি রাজনীতিকদের হাতে যে রাজনীতি রাখার কথা বলেছেন, সেটি মান্য করতে হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি, প্রেসিডিয়াম, উপদেষ্টামণ্ডলী থেকে অনেকেই ঝরে পড়বেন। নির্বাচনের আগে তো নয়ই, পরেও কোনো দল সেই ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।

নির্বাচন সামনে রেখে ইতিমধ্যে সাবেক আমলা ও বর্তমান ব্যবসায়ীরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। সম্প্রতি খুলনার একটি আসনে উপনির্বাচনে এমন এক ব্যবসায়ী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি একজন সাবেক কৃতী ফুটবলারও। কিন্তু দেশবাসী তাঁকে আওয়ামীবিরোধী শিবিরের সমর্থক ব্যবসায়ী হিসেবে জানত। আরেকজন ব্যবসায়ী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনে প্রচারও শুরু করে দিয়েছিলেন, যদিও সেই নির্বাচনটি আর হয়নি।

অন্য চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পেশাজীবীদের রাজনীতিতে আসার কড়া সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু রাজনীতিতে এখন অবসরপ্রাপ্তদের দৌরাত্ম্যই বেড়ে চলেছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে কতজন অবসরপ্রাপ্ত ইঁদুর দৌড়ে আছেন, তা হিসাব করে বলা কঠিন। কোনো কোনো আসনে একাধিক অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি মনোনয়ন লাভের জন্য জোর প্রচার চালাচ্ছেন। সেসব নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটির ঘটনাও ঘটছে। আবার কেউ কেউ চাকরিতে থাকা অবস্থায়ই প্রচার চালাচ্ছেন, তফসিল ঘোষণার এক–দুদিন আগে পদত্যাগ করে নিজের প্রার্থিতা জায়েজ করবেন। তখন রাজনীতিতে নবাগত ‘হরিপদ কেরানিদের’ সঙ্গে বনেদি ‘আকবর বাদশাহদের’ কোনো পার্থক্য থাকবে না।

রাষ্ট্রপতি রাজনীতিকদের হাতে রাজনীতি নিয়ে আসার কথা বলেছেন। কিন্তু এখন অরাজনীতিকদের হাতেই রাজনীতি জিম্মি হয়ে পড়েছে।

ডাকসুর শেষ না হওয়া গল্প
গত বছর মার্চের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ মাস্ট’। ডাকসু নির্বাচন হতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলে গত দেড় বছরে নির্বাচনটি করে ফেলতে পারত। কিন্তু তারা করেনি। টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর তারা আগামী বছরের মার্চে সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করলেও সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না। ক্যাম্পাসে সরকার–সমর্থক ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের তৎপরতা নেই। এমনকি সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়েও তাদের হাতে দফায় দফায় মার খাচ্ছেন।

উপাচার্য মহোদয় যেদিন ডাকসু নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন, সেদিন আমরা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ছাত্রদলের সভাপতির আলিঙ্গনবদ্ধ ছবি দেখে কিছুটা আশান্বিতও হয়েছিলাম। কিন্তু সেই ছবির রেশ না কাটতেই ছাত্রদলের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা হলো, কেউ কেউ আটক হলেন।

তাহলে ডাকসু নির্বাচন কীভাবে হবে?
ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়ায় রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু তারা নির্বাচন করতে না পারলে সেই ধন্যবাদ ফিরিয়েও নিতে হবে এবং আবারও রাষ্ট্রপতিকে ডাকসু নিয়ে সবক দিতে হবে। সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]