কোটা: শেষ হয়েও হচ্ছে না শেষ

কোটা বহালের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা
কোটা বহালের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা

সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির প্রবেশ পদে সব ধরনের প্রাধিকার কোটা তুলে দিয়েছে। নিয়োগ হবে শুধু মেধার ভিত্তিতে। এ বছরের গোড়ার দিকে কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে বড় একটি ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। তাঁদের দাবি ছিল কোটার হার কমানোর, সব কোটা বাতিলের দাবি তাঁরা তোলেননি। আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠনের হামলার শিকার হয়েছেন, আহত হয়েছেন, মামলার আসামি হয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্দোলন চলাকালে সংসদে ঘোষণা দেন, সব কোটা বাতিল করা হবে। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিকে পর্যালোচনা করে সুপারিশ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই কমিটি সুপারিশ করে, কোনো ক্ষেত্রেই প্রাধিকার কোটার আর প্রয়োজন নেই। তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে প্রবেশ পদে সব ধরনের কোটা বিলুপ্তির ঘোষণা দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারি হয়।

আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল শূন্য পদের ৯০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু সরকার শতভাগ শূন্য পদেই মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করল। সংস্কার দাবির মূল ইস্যু ছিল মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া। তাহলে বলা যায়, সরকার উচ্চতর সিভিল সার্ভিসে শুধু মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে অযৌক্তিক কিছু করেনি; বরং এতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ ও পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকা–সংক্রান্ত সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদের বিধান প্রতিপালন নিশ্চিত করা হয়েছে।

তবে সাধারণত সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তেই কারও না কারও অসুবিধার কারণ হতে পারে। এমনকি কোনো ক্ষেত্রে কর ধার্য বা বৃদ্ধি করলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর বিপরীতে বক্তব্য দিতে পারেন। বিবেচ্য ক্ষেত্রে ঠিক এমন না হলেও দীর্ঘদিন যাঁদের প্রাধিকার কোটার সুরক্ষায় উচ্চতর চাকরি সহজলভ্য ছিল, তাঁরা প্রতিবাদী হবেন—এটাই স্বাভাবিক। দেখা যাচ্ছে প্রাধিকার কোটা ভোগকারী কোনো কোনো মহল সভা–সমাবেশের মাধ্যমে কিছু কোটা বহালের দাবি জানাচ্ছে। তাদের ক্ষোভের যৌক্তিকতা ও পরিসর তলিয়ে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে। প্রাধিকার কোটা ছিল মূলত মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য, নারী, জেলা, উপজাতি ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। সংবিধানের ২৯ (৩) অনুচ্ছেদের ক অংশে নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বে নিশ্চয়তার জন্য বিশেষ বিধান রয়েছে। সে বিবেচনা থেকেই নারী, জেলা, উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটা চালু করা হয়েছিল। সময়ান্তরে লক্ষ করা যায়, মেয়েরা ছেলেদের মতোই পড়াশোনায় ভালো করছে। আর যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি গোটা দেশকে একসূত্রে গেঁথে ফেলায় জেলা কোটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। উল্লেখ্য, আমাদের প্রতিবেশী বিশাল ভারতে নারী কোটা ও কোনো আঞ্চলিক কোটা নেই। দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাইয়ের প্রতিযোগীর সঙ্গে মেঘালয়, আন্দামান ও লাদাখের প্রতিযোগী একই সারিতে থাকেন। সুতরাং এই দুটো কোটা রাখা অনাবশ্যক বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। প্রতিবন্ধী কোটার বিপরীতে ভিন্ন কোনো মত নেই। এ প্রাধিকারটি রাখা যৌক্তিক। উপজাতি কোটার সুফলভোগী মাত্র গোটা চারেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা। এমনকি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সাঁওতালদেরও উচ্চতর সিভিল সার্ভিসে কোনো প্রতিনিধিত্ব দেখা যায় না।

উল্লেখ্য, আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের কিছু বেশি। তাদের জন্য সংরক্ষিত আছে ৫ শতাংশ কোটা। তাদের জাতিসত্তার প্রতি পুরো সম্মান ও সমর্থন রেখে বলব, এই প্রাধিকার কোটায় অংশগ্রহণের ভিত বাড়াতে হবে। বঞ্চিত জাতিসত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও বিবেচনা করা যায়। যাঁরা সফল, তাঁদের মধ্যে সচিব, মেজর জেনারেল, পুলিশের বড় কর্মকর্তাও কেউ কেউ হয়েছেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সুবিধা নিতে পারেন না। ভারতে যাঁদের পিতা বা মাতা সরকারি বা বেসরকারি দ্বিতীয় শ্রেণির বা সমমানের চাকরি করেন বা যাঁদের একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বার্ষিক আয় আছে, তাঁরা অন্যান্য অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কোটা ভোগ করতে পারেন না। আমাদের উপজাতি কোটা চালু করা হলে এই বিধান করা দরকার।

সবচেয়ে স্পর্শকাতর হলো মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোটা। কেউ এর বিলুপ্তি চাননি। তবে উল্লেখ করতে হয়, সংবিধানে তাঁদের জন্য প্রাধিকার কোটা সংরক্ষণের কোনো বিধান নেই। অথচ সংবিধানপ্রণেতারা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ধারণা করা যায়, তাঁরা সচেতনভাবেই তা রাখেননি। তাঁদের পূর্ণ আনুগত্য ছিল সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করা–সংক্রান্ত সংবিধানের প্রস্তাবনার ওপর। তা সত্ত্বেও ১৯৭২ সাল থেকে এই কোটা চলে আসছে। সেটা তখনকার সময়ের দাবিও ছিল। এখনো অবশ্যই ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এ নামে যৌক্তিক সংখ্যক প্রাধিকার কোটা রাখা যেতে পারে। সেখানে বিবেচনা করতে হবে মোট জনসংখ্যার তুলনায় তাঁদের সংখ্যার দিকটি। এখন পর্যন্ত নিবন্ধনকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩ লাখের কম। সুতরাং তাঁদের পোষ্যের সংখ্যা ১৫-১৬ লাখ হতে পারে, অর্থাৎ জনসংখ্যার ১ শতাংশ। তা ছাড়া আরও বিবেচনায় নিতে হবে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে যাঁরা সরকারি চাকরি করেছেন, তাঁদের সন্তানাদি সে সনদেই আবার এই সুবিধা ভোগ করতে পারেন কি না। উল্লেখ্য, কেউ কেউ করছেন। অনেকেই এভাবে সুবিধা ভোগ করাকে অনৈতিক মনে করেন। তা ছাড়া তৃতীয় প্রজন্মে এর সুবিধা প্রসারিত করাও সংগত হবে না। এই প্রাধিকার কোটার সংখ্যাও ছিল অত্যধিক বেশি। তা চলছিল দীর্ঘদিন। এর সুবিধাদির লোভে পড়ে বেশ কিছু মানুষ জালিয়াতি করেও সনদ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ছিলেন। বিষয়টি উন্মোচিত হলেও কারও কিছু হয়নি। এখন এই কোটা আবার চালু করলে সংখ্যা বা হারটা সংগতিপূর্ণ করা উচিত এবং কিছু বিধিনিষেধের আওতায় আনা উচিত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এত কিছুর পরেও আবার এসব কথা কেন? কথা হবেই। বাস্তবতা সব সময়ই পরিবর্তনশীল। যে বাস্তবতায় কোটা–সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে, তা অমূলক নয়। এ দেশে স্বাধীনতার পর থেকে প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য অনেক কমিশন-কমিটি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে গঠিত হয়েছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী কমিশন। তারপর আবদুর রশিদ কমিশন। ১৯৯৪ সালে তদানীন্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব আইয়ুবুর রহমানের নেতৃত্বে ৪ সচিবের কমিটি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। ২০০৯ সালে আকবর আলি খান ও রকিব উদ্দিন আহমেদের পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ। স্বাধীনতার পর থেকে সরকারি কর্ম কমিশনের বিভিন্ন বার্ষিক প্রতিবেদন। এগুলো তেমন কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই মেধার ভিত্তিতে সিভিল সার্ভিস গড়ে তুলতে পরামর্শ দিয়েছে। এমনকি ২০১২ সালে সরকার–অনুমোদিত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্রে মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে কোটাব্যবস্থার সংস্কারের অঙ্গীকার রয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় কোটা বিলুপ্তির জন্য সচিব কমিটি সুপারিশ করেছিল বলে জানা যায়। এমনকি এটা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের মতামতও নেওয়া হয়েছে। সব দিক বিচার–বিশ্লেষণ করে মন্ত্রিসভা সচিব কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করেছে।

তবে বিক্ষুব্ধদের কিছু কথাও আমলে নেওয়ার থাকে। সমাজের অনগ্রসর শ্রেণিকে মূলধারায় আনার জন্য তো সাংবিধানিক ব্যবস্থাও রয়েছে। এ ধরনের ইতিবাচক পক্ষপাত বা অ্যাফারমেটিভ ডিসক্রিমিনেশন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে। আমাদের এখানেও ছিল। এখনো নিচের দিকের চাকরিগুলোতে তা থাকছে। তাহলে ওপরের দিকেও কিছু পরিমাণে থাকলে দোষ হবে না। যাঁরা কোটা সংস্কারের দাবি করেছেন বা তাঁদের সমর্থনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কলম ধরেছেন, বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁরাও এর বিরুদ্ধে ছিলেন না। এখনো বিরুদ্ধে নন। প্রতিবন্ধী ও উপজাতি কোটা (কিছু সংস্কারসহ) সহজেই থাকতে পারে। তেমনি ইতিহাসের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে যৌক্তিক হারে থাকতে পারে মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য কোটা। যখন মেধাকেই সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তখন কিছু ক্ষেত্রে সামান্য হারে কোটা সংরক্ষণে তেমন কোনো আপত্তি আসবে বলে মনে হয় না।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali [email protected]