শুরু হয়ে গেল ভোট-পার্বণ

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ওমপ্রকাশ রাওয়াত
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ওমপ্রকাশ রাওয়াত

যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটে গেল ভারতের নির্বাচন কমিশন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দেওয়ায়। বছরটা শেষ হবে নির্বাচনী ফলাফল কাটাছেঁড়ার মধ্য দিয়ে এবং নতুন বছর শুরু হবে লোকসভা ভোটের ফল নিয়ে রাজনৈতিক চাপান–উতরের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মতো গোটা ভারতও এখন আক্ষরিক অর্থে ‘ইলেকশন মোড’–এ চলে গেছে।

যে রাজ্যগুলোয় এই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ভোট এবং ফল ঘোষণা ১১ ডিসেম্বর, সেগুলোর মধ্যে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় বিজেপির দখলে। মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির থাবা প্রায় মৌরসি পাট্টার মতো গেড়ে বসেছে। হওয়ারই কথা। কেননা, টানা পনেরোটা বছর ধরে বিজেপি এই দুই রাজ্যে কংগ্রেসকে দাঁত ফোটাতে দেয়নি। রাজস্থান সেই তুলনায় অন্য রকম। মরু রাজ্যের বাসিন্দারা বহুকাল হলো কংগ্রেস বা বিজেপি কাউকেই পাকাপাকি কোল পেতে দিচ্ছে না। পাঁচ বছর অন্তর তারা এই দুই দলকে পাল্টাপাল্টি সুযোগ দিয়ে আসছে। সেই নিরিখে রাজ্যটা এবার কংগ্রেসের পাওয়ার কথা। তারা আশাবাদীও।

বাকি দুই রাজ্যের একটি মিজোরাম, অন্যটা তেলেঙ্গানা। ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের এই মিজোরামেই কংগ্রেসের প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে। বাকি সব হাতছাড়া হয়ে গেছে বিজেপি অথবা তাদের স্থানীয় শরিকদের দরুন। ভারতের মানচিত্রে এই অংশ যতটা উজ্জ্বল, দেশজ রাজনীতিতে তার উপস্থিতি ও প্রভাব ততটাই করুণ।

‘মেনল্যান্ড ইন্ডিয়া’র রাজনীতিকে উত্তর–পূর্বাঞ্চল কোনো দিনই সেভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। আগামী দিনেও পারবে না। কাজেই মিজোরামে কংগ্রেস টিকে থাকতে পারে কি না, তার ওপর জাতীয় রাজনীতির কিছুই নির্ভর করবে না। কিন্তু হাতছাড়া হলে কংগ্রেসের মুখ আরও একটু পুড়বে, বিজেপির হাসি আরও কিছুটা চওড়া হবে।

তেলেঙ্গানায় ভোট হবে এই প্রথম। অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালের বিধানসভা ভোটের পর। আসন বেশি পাওয়ায় নতুন রাজ্যের শাসনভার বর্তেছিল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতির নেতা চন্দ্রশেখর রাওয়ের ওপর।

কিন্তু ২০১৯ পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে চন্দ্রশেখর রাও বিধানসভা ভেঙে দিয়ে একটা ঝুঁকি নিয়েছেন। তিনি আবার ক্ষমতা দখল করলে সেটা হবে
কংগ্রেসের আরও একটা হার। হেরো বদনাম ঘোচাতে কংগ্রেস এই রাজ্যের অপর বিরোধী দল তেলেগু দেশম পার্টির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চাইছে। দেখা যাক কী হয়।

বছর শেষের এই ভোট সেই দিক থেকে দেখতে গেলে বিজেপি ও কংগ্রেসের দ্বৈরথ। কেননা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির লড়াই প্রায় পুরোটাই কংগ্রেসের সঙ্গে। ঠিক এই কারণেই এত দিন ধরে জল্পনা চলছিল, লোকসভা ভোটের আগে এই তিন রাজ্যে ভোট করে বিজেপি বড়
একটা ঝুঁকি নেবে কি না। তিন রাজ্যেই কংগ্রেস তেড়েফুঁড়ে নেমেছে।

রাজ্যগুলো হাতছাড়া হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ‘ম্যান ফ্রাইডে’ দলনেতা অমিত শাহর নেতৃত্ব ঘিরে যেমন প্রশ্ন উঠবে, তেমনই ওই সব রাজ্য জয় মৃতসঞ্জীবনী সুধার কাজ করবে কংগ্রেসের কাছে। একটা মহল তাই মনে করছিল, মোদি–শাহ জুটি কিছুতেই ওই ঝুঁকি নেবেন না। ‘এক দেশ এক ভোট’–এর আওয়াজ তুলে এই রাজ্যগুলোর ভোটও লোকসভার সঙ্গে করানোর প্রস্তাব দেবেন। কিন্তু দেখা গেল, সেই রাস্তায় বিজেপি হাঁটল না।

এই ঝুঁকি না নেওয়ার পেছনে অনুঘটকের কাজটা করলেন বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী। কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা অসম্পূর্ণ রেখেই তিনি এই তিন রাজ্যে আলাদা লড়াইয়ের কথা জানিয়ে দিলেন। মায়াবতী প্রথম সিদ্ধান্ত নেন ছত্তিশগড় নিয়ে। সেখানে কংগ্রেসের দলছুট নেতা ও রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অজিত যোগীর দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কথা জানালেন। তার দিনকয়েক পরেই কংগ্রেসের রাজ্য নেতাদের দোষারোপ করে বলে দিলেন, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানেও তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করছেন না।

মায়াবতীর এই সিদ্ধান্ত ওই তিন রাজ্যের সম্ভাব্য ফলে কতটা হেরফের ঘটাবে, তা পরের কথা, এই মুহূর্তে দেশের ছোট ছোট বিজেপিবিরোধী দলগুলো জোটের প্রশ্নে কংগ্রেসের ‘অনড় মানসিকতার’ নিন্দেমন্দ শুরু করেছে। পাশাপাশি আশায় বুক বাঁধতে সাহায্য করছে বিজেপিকে।

মায়াবতী যে এমন কিছু একটা করতে চলেছেন, সেই ইঙ্গিত কিছুদিন ধরেই ছিল। রাজনৈতিক জল্পনা এই রকম, মায়াবতী ও তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে মামলাগুলো সিবিআই বা এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের হাতে রয়েছে, বিজেপি সেগুলো হাতিয়ার করে দলিত নেত্রীকে চাপ দিচ্ছে। সওদাটা হলো, বিজেপির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হলে দুর্নীতির ফাঁস গলায় চেপে বসবে। এ দেশে মজাটা হলো, এই ধরনের রাজনৈতিক সওদাবাজির কোনো প্রমাণ কেউ কোনোকালে করতে পারেনি। পারবেও না।

মায়াবতী অবশ্য সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনো কুমন্তব্য করেননি। বরং বলেছেন, ওঁরা জোট নিয়ে যথেষ্টই আন্তরিক। বাদ সেধেছেন রাজ্য নেতারা। তিনি যে নেতার নাম করেছেন, সেই দিগ্বিজয় সিংয়ের দাম রাহুলের কংগ্রেসে এখন যৎকিঞ্চিৎ।

বেশ বোঝা যায়, মায়াবতী একটা অজুহাত খুঁজছিলেন। তবে উত্তর প্রদেশে জোটবদ্ধ হওয়ার বিষয় নিয়ে তিনি একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। বোঝাই যাচ্ছে, ২০১৯–এর এই মোক্ষম প্রশ্নটা তিনি ঊহ্য রাখতে চাইছেন। রাজনীতিতে সব সওদা কি আর একসঙ্গে হয়?  

মায়াবতী কংগ্রেসের সঙ্গে এই তিন রাজ্যে না গেলে বিজেপি যে ড্যাং ড্যাং করে আরও একবার ক্ষমতা দখল করবে, সেই নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। সাম্প্রতিক জরিপগুলো বরং বলছে, রাজস্থান কংগ্রেসের পকেটে। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের সম্ভাবনা ৫৫–৪৫। ছত্তিশগড়ে ৫০–৫০। রাজস্থান যে ‘লস্ট কেস’, বিজেপি নেতারা নিভৃত আলোচনায় তা স্বীকারও করছেন।

কিন্তু মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় নিয়ে তাঁরা আশার আলো দেখতে ছাড়ছেন না। এর একটা কারণ যদি হয় মধ্যপ্রদেশের দুই কংগ্রেস নেতা বর্ষীয়ান কমলনাথের সঙ্গে তরুণ জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রশ্ন ঘিরে টানাপোড়েন, অন্যটা তা হলে মায়াবতীর স্বতন্ত্র উপস্থিতি।

মধ্যপ্রদেশের যে অংশ উত্তর প্রদেশের লাগোয়া, সেই বুন্দেলখন্ড এলাকায় কুড়ি–তিরিশটা আসনে দলিত নেত্রীর সমর্থন এই ক্ষুরধার প্রতিযোগিতার বাজারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টানা পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকা বিজেপির কাছে এই ভোট বিভাজন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতো।

কংগ্রেস শিবিরে মায়াবতীর না যাওয়া বিজেপিকে সব থেকে বেশি আশা দেখাচ্ছে ছত্তিশগড়ে। এই রাজ্যে তফসিল উপজাতিদের আধিক্য প্রবল। অজিত যোগী উপজাতি হওয়ায় তাঁর একটা প্রভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে মায়াবতীর উপস্থিতি যতটা ভোট টানবে, তা ভাগ ধরাবে বিরোধী শিবিরেই। কী করে এর মোকাবিলা কংগ্রেস করে, তা দেখার বিষয়।

এই তিন রাজ্যে বিজেপির একমাত্র আশা–ভরসা নরেন্দ্র মোদি। তাঁকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছে রণনীতি। রাজস্থান হাতছাড়া হলেও মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় যদি দখলে রাখা যায়, সেটাই হবে তাদের বাড়তি পাওনা। এটা যেমন সত্যি, তেমন এ কথাও সত্য যে ওই দুই রাজ্য দখলে আনতে না পারলে ২০১৯–এর নিরিখে সেটা হবে বিরোধীদের কাছে বিরাট ধাক্কা। কিন্তু তিন রাজ্যই যদি বিজেপির কবলমুক্ত হয়? কংগ্রেস তা হলে দ্বিগুণ তেজিয়ান তো হবেই, আগামী বছরের লড়াইয়ে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বকে দাঁড় করাতে পারবে কঠিন পরীক্ষার মুখে। পরীক্ষাটা রাহুলের কাছেও প্রবল, নিজেকে প্রমাণ করার।

কিন্তু সেই লড়াইয়ে, টেনিসের পরিভাষায় বলা যায়, এখনো ‘অ্যাডভান্টেজ মোদি’। বিজেপিতে তো অবশ্যই, ভোটের ফল বেরোনোর আগে পর্যন্ত এনডিএ জোটেও নেতৃত্বের প্রশ্ন ঘিরে কোনো দ্বিমত নেই। অথচ বিরোধী শিবির? রাহুল গান্ধীকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন। রাহুলকেও তাই বারবার বলতে হচ্ছে, সবাই রাজি থাকলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। কিন্তু সবাই রাজি না হলে? এই প্রশ্ন এখনো উত্তরহীন। বিজেপির তুরুপের তাসও এটাই। এই প্রশ্নটা। ‘মোদি বনাম?’

ভোট–পার্বণ শুরু হয়ে গেল। আগামী বছর ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আবহসংগীতও বছর শেষেই রচিত হতে চলেছে।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি