সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে?

ষাটের দশকের ঢাকায় জাহানারা ইমাম গাড়ি চালিয়েছেন। এমনকি ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্যেও তিনি গাড়ি চালিয়েছেন, সেই স্মৃতি আমরা তাঁর একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে পাই। আমার লেখা মা বইয়ে আছে, আজাদের ছোটমা গাড়ি চালিয়ে আজাদকে নিয়ে যাচ্ছেন গুলিস্তানে, এলভিস প্রিসলির রেকর্ড কিনে দেবেন বলে। আনিসুজ্জামান স্যারের লেখায় পাই, মুনীর চৌধুরী একটা সুন্দর গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন ঢাকার রাজপথে। নানাজনের স্মৃতিকথায় পাই, ঢাকায় সাইকেল চালাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজের অধ্যাপকেরা। ষাটের দশকের ঢাকা, যা আমি চোখে দেখিনি, কিন্তু কল্পনা করতে পারি, তা খুব সুন্দর ছিল বলেই মনে হয়। একটা শিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল। তাই তো এ দেশে সিনেমার নাম হতে পেরেছিল অ আ ক খ, নীল আকাশের নিচে, আয়না ও অবশিষ্ট।

দেশ স্বাধীন হলো। ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত বড় হতে লাগল। গ্রামে–গঞ্জে টেলিভিশন ছড়িয়ে পড়তে লাগল। টেলিভিশনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কথা বলতেন, সেই কথা শোনার জন্য টেলিভিশনের সামনে দর্শকেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। তখন মুখরা রমণী বশীকরণ কিংবা রক্তকরবী ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি নাটক। তখনো টেলিভিশন নাটকের নাম হতে পেরেছিল রক্তে আঙুরলতা। তারপর এল হুমায়ূন আহমেদের কাল।

সেই মধ্যবিত্ত আর আছে কি না, এটা একটা প্রশ্ন, যেটা সমাজবিজ্ঞানীরা হিসাবে আনতে পারতেন। আগে অধ্যাপক, কবি, শিল্পী এই ঢাকায় ছিলেন শ্রদ্ধেয়। ঢাকার বাইরেও সমাজে শিক্ষকের সম্মান ছিল। মানীর মান ছিল। তখনো লোকে বিশ্বাস করত, লেখাপড়া করে যেই, জুড়িগাড়ি চড়ে সেই। তখনো ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে একটা–দুটো উঁচু দোতলা–তিনতলা বাড়ি ছিল হয়তো তাদের, যাদের চাকরির বাইরে উপরি ইনকাম আছে।

ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, সাব–রেজিস্ট্রার সাহেবদের বাড়ি বড় ছিল, হয়তো গাড়িও ছিল, কিন্তু সমাজে শ্রদ্ধা আর মান্যতার আসনটা মাস্টার মশাইয়ের জন্যই নির্দিষ্ট ছিল।

সেই সমাজ ভেঙে গেছে। মধ্যবিত্ত বড় হচ্ছে। সেই মধ্যবিত্ত মাথাপিছু আয়ের হিসাবে মধ্যবিত্ত, কিন্তু স্বভাবে মধ্যবিত্ত কি না, সন্দেহ আছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক–বাহক যে মধ্যবিত্ত সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়, তারা কি অপসৃত হয়ে যাচ্ছে?

সিম্পল লিভিং হাই থিংকিংয়ের যে আদর্শবাদী মানুষেরা ষাটের দশকেও ছিলেন, যাঁরা অর্থবিত্তকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করতেন না, কখনো কখনো ঘৃণ্যও ভাবতেন, তাঁরা আজ বিলুপ্তপ্রায়। লুটেরা ধনিকেরা ২০ বছর আগেও সমাজে পাত পেতেন না। আজ তাঁদের টাকা হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁদের কালচার হয়নি। কিন্তু এখন ‘খারাপ টাকা ভালো টাকাকে অপসারিত করে ফেলেছে’। একজন ডাক্তার একটা একটা করে রোগী দেখে ৫০০ টাকা করে গুনে নিয়ে নিয়ে আর কত টাকা করবেন! এর চেয়ে ভাঙারির দোকানের মালিক সরকারি ব্যাংক থেকে দুই হাজার কোটি টাকা নেবেন, তিন হাজার কোটি টাকা নেবেন, আর ফেরত দেবেন না। তাঁর সঙ্গে একজন ডাক্তার কিংবা অধ্যাপক কিংবা একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক পারবেন কী করে?

সেই রকমই একটা কলাম ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক লিখেছিলেন, তিনি কোরবানির ঈদে ভাগে ৭০ হাজার টাকার একটা গরু কিনেছিলেন। তাঁর নাতি সেই গরু দেখে কেঁদে ফেলেছিল, কারণ বাড়ির নিচে সব চার–পাঁচ লাখ টাকার গরু। যাঁরা এই গরু কিনেছেন, তাঁদের গাড়ির নাম মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ ও লেক্সাস।

এই সমাজে কুড়ি বছর আগেও ঋণখেলাপিরা গ্রাহ্য হননি। ভূমিদস্যু, বনখেকো, নদীখেকো ও ব্যাংকলুটেরাদের মানুষ সমাজে বর্জনীয় বলে মনে করত। কিন্তু এখন মূল্যবোধসম্পন্ন মধ্যবিত্ত অপসারিত হয়ে গেছে। ধনিক মাত্রই এখন পূজনীয়। সেই ধনের উৎস নিয়ে কেউ আর কোনো প্রশ্ন তোলে না। আর বড়লোক হওয়ার সেই ইঁদুর দৌড়ে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আমলা, সাংবাদিকসহ নানা পেশাজীবীও শামিল হয়েছেন। সহজ উপায় হলো ক্ষমতার ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়া। নানা ধরনের সরকারি–বেসরকারি রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করা। যেভাবেই হোক টাকা করতে হবে। এখন টাকাই একমাত্র আরাধ্য। টাকাওয়ালাই সমাজে সবচেয়ে সম্মানিত।

মূল্যবোধের এই পরিবর্তন আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এসে ধাক্কা দিয়েছে। ভালো সিনেমা আর হয় না। ভালো গল্প-উপন্যাসও আর লেখা হয় না। আমাদের মায়েরা অবসর সময়ে শরৎচন্দ্র পড়তেন, আশাপূর্ণা দেবী পড়তেন; তাঁরা রিকশায় শাড়ি ঘিরে সিনেমা দেখতে যেতেন। সেই শ্রেণি তো কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

কিন্তু আরেকটা শ্রেণি বিপুলভাবে উঠে আসছে সারা বাংলাদেশ থেকে। প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। স্কুলে যাওয়াটাই একটা আগুনের পরশমণি। সাতক্ষীরা থেকে উঠে আসে মোস্তাফিজুর রহমান, জায়গা করে নেয় জাতীয় ক্রিকেট দলে। খুলনা থেকে আসে মেহেদী হাসান মিরাজ। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রাম থেকে আসে মারিয়া মান্দা। খেলে জাতীয় মহিলা কিশোরী ফুটবল দলে।

আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই, সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রেজাউল করিম রাজু আর দিয়া খাতুন মিমের কথা। রাজুর বাবা নেই, মা হাতিয়ায় অনেক কষ্ট করে দিন যাপন করতেন, কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন ঢাকায় রেখে। আর মিমের বাবা বাসের চালক। কিন্তু দুজনের চোখমুখে ঝলমল করত আশা আর আত্মবিশ্বাসের আলো। রাজু সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিল। দিয়া ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিল। দিয়ার বোন রিয়া ডাক্তার হতে চায়। মহাখালীতে দিয়া–রিয়াদের বস্তিঘরে আমি গিয়েছিলাম। দেড় রুমের ছোট্ট বাসা। সেই বাড়িতে থেকে দিয়া–রিয়া ডাক্তার–ব্যারিস্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

এদের সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এই চার কোটি শিক্ষার্থীই আমাদের ভবিষ্যৎ এবং এদের মধ্যেই নিহিত আমাদের সব আশা আর স্বপ্ন।

সমস্যা হলো এরা বিসিএসের গাইড বই কেনে, আউটসোর্সিং কিংবা সফল হইবার ১০০ উপায় বই কেনে। কিন্তু আউট বই কি এরা পড়ে? আমরাও এদের দেওয়ার চেষ্টা করি শুধু ক্যারিয়ারের গাইড।

আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মানের অবনমনের পেছনে এই বাস্তবতা দায়ী। আবার আশার কথা হলো এরা গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। প্রায় সবার হাতেই আছে মোবাইল ফোন এবং প্রায় সবাই ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। তিন–তিনটা বড় আন্দোলনে এদের আমরা রাজপথ কাঁপাতে দেখেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, কোটা সংস্কারের দাবিতে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে। এর মধ্যে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে তাদের ক্যারিয়ারের ভাবনা কাজ করেছে। কিন্তু শাহবাগের আন্দোলন কিংবা নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তাযুক্ত ছিল না।

আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। এখনকার প্রজন্ম আর আমাদের সময়ের প্রজন্ম এক নয়। সেই কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আর লোকসমাগম হয় না। কিন্তু নিরাপদ সড়কের দাবিতে লাখ লাখ তরুণ পথে নেমে আসে।

ধ্রুপদি মধ্যবিত্তের প্রায়-বিলুপ্তি একটা বাস্তবতা। লুটেরা ধনিকদের স্বর্গরাজ্যে পৌঁছে যাওয়া একটা বাস্তবতা। কিন্তু কোটি কোটি তরুণের উঠে আসাও আরেকটা বাস্তবতা। এর মধ্য থেকে আমাদের দেশ সঠিক রাস্তাটা খুঁজে পাবে কি না, সেটাই প্রশ্ন।

আমরা একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আমাদের মূল্যবোধ তার প্রধান শিকার। কিন্তু আমাদের নদী, পানি, মাটি, অরণ্য, আকাশও যে তার ক্রূর আক্রমণে নষ্ট–ভ্রষ্ট–ধ্বস্ত হচ্ছে, তার কী হবে?

কম মাথাপিছু আয়ের দেশে নাকি সুশাসন আসে না। ২০৩০ সালে আমরা ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছি, এইচএসবিসির এই ভবিষ্যদ্বাণী থেকে আশা করি, তখন আমাদের দেশে সুশাসনও আসবে। আশা ছাড়া আমাদের আর আছে কী!

হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। আমরা আশা করি, নষ্টদের অধিকার থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ একসময় সুন্দরের স্বর্গরাজ্য হবে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক