বৈষম্য কমানো

বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতির (কমিটমেন্ট টু রিডিউসিং ইনইকুয়ালিটি—সিআরআই) সূচকে বিশ্বের ১৫৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ১৪৮তম অবস্থান হতাশাব্যঞ্জক। আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈষম্য কমাতে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশ নিচের দিক থেকে দ্বিতীয়। ভুটান ছাড়া সব দেশের অবস্থানই বাংলাদেশের ওপরে।

একদিকে মানবসম্পদসহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকা, অন্যদিকে বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া সুস্থ ও স্বাভাবিক ঘটনা নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সবচেয়ে গরিবের আয়ের ভাগ ২ থেকে অর্ধেক কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয়ের ভাগই হয় কমেছে বা এক জায়গাতেই থমকে আছে। বিপরীতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের ভাগ ছিল ২০১০ সালে ২৪ দশমিক ৬১, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশে। এর অর্থ, সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে অধিক হারে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সিংহভাগ মানুষ উন্নয়নের কোনো সুফল পাচ্ছে না। যে প্রবৃদ্ধি সমাজের বৃহত্তর অংশ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছে না, তাকে সত্যিকার উন্নয়ন বলা যায় না। বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর থেকে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও বৈষম্য কমাতে কেন পিছিয়ে আছে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ হবে বলে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশের মধ্যে আছে। সে তুলনায় বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তেমন বাড়ছে না। প্রতিবছর যে ২০–২১ লাখ তরুণ–তরুণী কর্মবাজারে প্রবেশ করেন, তাঁদের অধিকাংশ কাজ পাচ্ছেন না। এভাবে বেকারত্ব ক্রমেই আরও বেড়ে চলেছে এবং এটা একটা গুরুতর সংকটের রূপ নিচ্ছে। বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক সমস্যাই সৃষ্টি করে না, এর অনেক নেতিবাচক সামাজিক প্রভাবও আছে। বেকারত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্যও বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি যেসব চাপের মধ্যে আছে সেগুলো হলো খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন, বিদেশি অর্থায়নের ঘাটতি, তারল্য-সংকট ও বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি। তবে আশার খবর হলো চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি কমেছে।

অক্সফামের জরিপে যেসব বিবেচনা করা হয়েছে, তার মধ্য রয়েছে সামাজিক খাতে ব্যয়, করনীতি এবং শ্রমিকদের অধিকার ও মজুরি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ করনীতিতে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও সামাজিক খাত এবং শ্রমিকদের অধিকার ও মজুরিতে বেশ পিছিয়ে আছে। এখানে শ্রমিকদের মজুরি তুলনামূলক কম। উদাহরণ হিসেবে তৈরি পোশাকশিল্পের কথা বলা যায়। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ তৈরি পোশাকশিল্প থেকে এলেও এই খাতের শ্রমিকেরা সবচেয়ে কম মজুরি পান। সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে, শ্রমিকদের কম মজুরি এবং বেশি মুনাফার নীতি সাময়িক সুবিধা দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে কোনো শিল্পের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।

জাতিসংঘ ২০৩০ সালের মধ্যে যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, বাংলাদেশ তা পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বৈষম্য ও দারিদ্র্য না কমিয়ে সেটি যে সম্ভব হবে না, তা হলফ করে বলা যায়। অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান দাতা সংস্থা হিসেবে অক্সফামের জরিপ করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তাদের দেওয়া কোনো তথ্য ভুল প্রমাণ করতে পারেননি। বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে, তা অস্বীকার করেনি এই সংস্থাটি। মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী সরকার যদি বৈষম্য নিয়ে সচেতনই থাকে, তাহলে সেটি কমাতে কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন?